“নিজের কষ্টের টাকা পাইতে এখন রইদের মইধ্যে রাস্তায় নামছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে।”
Published : 21 Apr 2024, 08:31 PM
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বিসিক শিল্পাঞ্চলে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত ৫০ শ্রমিক ও ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শুরু হওয়া এ সংঘর্ষ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায়।
শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানান শ্রমিকরা।
আব্দুর রাজ্জাক নামে ৩০ বছর বয়সী ওই শ্রমিক আশঙ্কামুক্ত বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া চিকিৎসকের বরাতে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ওই শ্রমিকের শরীরের কয়েকটি স্থানে ছররা গুলির আঘাত রয়েছে।”
এর আগে রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় মার্চের বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্পঞ্চলে অবস্থিত ক্রোনী গ্রুপের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ‘অবন্তী কালার টেক্স লিমিটেডের’ কয়েকশ শ্রমিক। এ সময় ওই সড়কের কয়েক কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়।
শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার আইনুল হুদা বলেন,
অবরোধ চলাকালীন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বেলা দেড়টার দিকে সংঘর্ষ থামলেও বিকাল পর্যন্ত ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখেন শ্রমিকরা। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শ্রমিকরা সড়ক ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শ্রমিক বিক্ষোভ চলার মধ্যেই বেলা ১২টার দিকে কারখানার গেটে একটি নোটিস সাঁটিয়ে দেওয়া। তাতে বলা হয়, কারখানাটি আগামী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করায় আরও ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা। এই সময় পুলিশ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
পরে শ্রমিকদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও জলকামান দিয়ে পানি ছুড়লে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে শ্রমিকদের ছোড়া ইট-পাটকেলের বিপরীতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলি ছোড়ে।
শিল্প পুলিশের কর্মকর্তা আইনুল হুদা বলেন, “শ্রমিকদের ছোড়া ইটপাটকেলে অন্তত ১০ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশ অ্যাকশনে যায়।
“শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে।”
শিল্প পুলিশ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো.আসাদুজ্জামান বলছিলেন, “আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টি সুরাহা করছেন না ওই কারখানার মালিক। এখন শ্রমিকরা যদি বেতন না পায়, তাহলে তারা তো বিক্ষোভ করবেই।
“এই কারখানায় এর আগেও অসংখ্যবার এমন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের শিল্প পুলিশের বড় একটি অংশ ওই কারখানার সামনে প্রায় সারাবছরই মোতায়েন করে রাখতে হয়। বিষয়টি ব্যবসায়ী নেতারাও জানেন। যদি কারখানার মালিক এটি সমাধান না করে তাহলে সুরাহা করা মুশকিল।”
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানান শিল্প পুলিশের এ কর্মকর্তা।
সংঘর্ষ চলাকালীন পুলিশ ৮৫ রাউন্ড রাবার বুলেট ও শটগান থেকে ১৩ রাউন্ড কাঁদানো গ্যাস ছোড়ে বলে জানান শিল্প পুলিশের পরিদর্শক (গোয়েন্দা ও ইনটেলিজেন্স) মো. সেলিম বাদশা।
পুলিশের ছোড়া ওই কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের আঘাতে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হয়ে স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন জানান তারা।
আবন্তী কালার টেক্স লিমিটেডের শ্রমিক জারিদুল মণ্ডল বলেন, “আমরা সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলাম। হঠাৎ পুলিশ আমাদের ওপর লাঠিচার্জ ও গুলি ছুড়তে শুরু করে।
“এতে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের পরিশ্রমের ন্যায্য পাওনার দাবিতে সড়কে নেমেছি। আমাদের বেতন দিয়ে দিলে তো এই রোদের মধ্যে সড়কে থাকার কথা না।
ন্যায্য পাওনা দাবি করা কি আমাদের অপরাধ? তাহলে পুলিশ কেন আমাদের ওপর গুলি চালাল?
“আমরা যদি সময়মতো বেতন পেতাম তাহলে আমাদের রাস্তায় আসতে হতো না।” বলেন মো. ফয়সাল নামে কারখানার আরেক শ্রমিক।
এর আগে সকালে বিক্ষোভরত শ্রমিকরা জানান, ঈদের আগে গত ৮ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত কাজ করার পর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন শ্রমিকরা ঈদের বোনাস পেলেও মার্চ মাসের বেতন বকেয়া ছিল।
কারখানার মালিক ঈদের আগেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করবেন বলে আশ্বাস দিলেও তা দেননি। এতে ঈদের মধ্যে অর্থ সংকটে দিন কাটিয়েছেন বলে জানান শ্রমিকরা।
কারখানাটির শ্রমিক সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের দিন খুব কষ্টে যাচ্ছে। ঈদে দেশে যেতে পারিনি। বউ-বাচ্চাসহ শহরে ভাড়া বাসায়ই থাকছি।
“বাসা ভাড়াও দিতে পারি নাই। বাড়িওয়ালা বারবার তাগাদা দিচ্ছে। এখন তো দুই মাস ভাড়া বাইজা গ্যাছে। মার্চের বেতন পাই নাই, এপ্রিলও শ্যাষের দিকে। এখন কোন মাস রাইখা কোন মাসের বেতন দিবো বুঝতেছি না।”
গত আট মাস যাবৎ বেতন নিয়ে কারখানার মালিকপক্ষ গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ করেন কারখানাটির আরেক শ্রমিক মো. আলম। বলেন, “ঈদের দিনও মোবাইল হাতে নিয়া বইসা ছিলাম বেতন ঢুকবো, এই আশায়।
“প্রতিমাসেই বেতনের লাইগা রাস্তায় নামতে হইতেছে। সামনে কোরবানির ঈদ, ওই ঈদেও আমাগো লগে এমন হইবো।”
সুমি নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, “আমাগো আর ঈদ আনন্দ নাই। রোজার মইধ্যে ডাবল ডিউটি কইরাও বিল পাই নাই। এমন কী রোজার ডিউটির সময় ইফতারের খরচটাও দেয় নাই। নিজের কষ্টের টাকা পাইতে এখন রইদের মইধ্যে রাস্তায় নামছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে।”
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কারখানাটির মালিক প্রতিষ্ঠান ক্রোনী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম সানি বুধবার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করবেন বলে জানান।
শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঈদের আগে সব শ্রমিককে বোনাস দিয়েছি, কিন্তু শিপমেন্ট ঠিকমতো না হওয়ায় মার্চের বেতনটা দিতে পারিনি। আমরা আগামী বুধবারের মধ্যে সকলের বেতন পরিশোধ করে দেব।”
এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি অবন্তী কালার টেক্স লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়কে বিক্ষোভ করেছিলেন।
এ এইচ আসলাম সানির মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী এ পোশাক কারখানাটির ডাইং ও নিটিংসহ বিভিন্ন সেকশনে অন্তত সাত হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ।