দেড়শ বছরের পুরাতন এই খেয়া ঘাট উত্তরবঙ্গের জেলা পাবনা, রাজশাহী, বগুড়াসহ অন্যান্য জেলাগুলোর সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের রাজবাড়ী, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর জেলার যোগাযোগের সহজ মাধ্যম।
Published : 18 Feb 2023, 05:38 PM
পদ্মার নাব্য সংকটে নদীর পাড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর খেয়া ঘাটটি। মাঝখানে ধু ধু বালুচর; যেখানে হাঁটাও কষ্টকর। তাই এই নৌপথ ব্যবহারকারী যাত্রীদের ভরসা হয়ে উঠেছে ঘোড়ার গাড়ি।
হাবাসপুর খেয়া ঘাট ব্যবহার করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া খেয়া ঘাটে যাতায়াত করেন রাজবাড়ীর পাংশা, মাগুরার শ্রীপুর, ঝিনাইদহের শৈলকুপা, ফরিদপুরের মুধুখালী, কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ।
কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাড় থেকে ঘাট সরে যাওয়ায় এই যাত্রীরা খেয়া ঘাটে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। ৪০-৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেও বাতাসে বালি উড়ায় দুর্ভোগের শিকার হয়েই ঘাটে পৌঁছাতে হচ্ছে তাদের।
সরেজমিনে পাংশা উপজেলার হাবাসপুর খেয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পাড় থেকে যত দূর চোখ যায় শুধু ধূ ধূ বালু। কেউ কোথাও নেই।
নদীর পাড় থেকে ১০০ ফুট দূরে ৮ থেকে ১০টি ঘোড়ার গাড়ি যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সেসব গাড়িতে মাঝে মাঝে যাত্রী পরিবহন দেখে মনে হবে বহু বছর আগের দৃশ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাবাসপুর খেয়া ঘাটের একজন ইজারাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেড়শ বছরের পুরাতন এই খেয়া ঘাট উত্তরবঙ্গের জেলা পাবনা, রাজশাহী, বগুড়াসহ অন্যান্য জেলাগুলোর সঙ্গে দক্ষিণ বঙ্গের রাজবাড়ী, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর জেলার যোগাযোগের সহজ মাধ্যম। এই নৌপথ ব্যবহার করে প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ যাতায়াত করে।
আনোয়ার হোসেন নামে একজন পথচারি বলেন, “রাজবাড়ী আর পাবনা জেলার যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হলো এটি। অনেক বছর ধরেই শুনে আসছি যাতায়াত সহজ করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হবে সেটা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। হয়তো অদূর ভবিষতে হবে, আমরা না দেখলেও ভবিষৎ প্রজন্ম দেখবে।“
তিনি আরও বলেন, “যে ঘোড়ার গাড়ি চলে যাওয়ার কথা জাদুঘরে সেই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে। আধুনিক এই যুগে যাতায়াতে যে ভোগান্তি, এ বড় কঠিন ভোগান্তি। এর থেকে দুঃখজনক আর কিছুই নেই।”
৭০ বছর বয়সী আহম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদী শুকিয়ে গেছে। এখন চার-পাঁচ কিলোমিটার শুধু বালু আর বালু। ঘোড়ার গাড়িতে উঠলে ভাড়া লাগে ৪০-৫০ টাকা, খেয়া পার হতে লাগে আরও ৫০ টাকা। আমরা তো গরিব মানুষ।
“নদী পার হতে গিয়ে ১০০ টাকা খরচ করবার মত সামর্থ্য নেই আমার। তাই বালুর মধ্যে হেঁটে হেঁটে খেয়া ঘাটে যাচ্ছি।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মো. ছকির উদ্দিন প্রামাণিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নদী পাড়ি দিতে খুবই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ বালুর মধ্যে হেঁটে হাবাসপুর খেয়া ঘাটে যেতে হচ্ছে। এরপর নদী পার হয়ে আবারও কয়েক কিলোমিটার হাঁটা লাগে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
“এজন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই, আমাদের যাতায়াতের জন্য একটা ব্রিজ করে দিলে খুবই ভালো হয়। আর যদি ব্রিজ না করে তাহলে এই সময়ে যাতে পাড় থেকে নৌকায় উঠতে পারি তার জন্য ড্রেজার দিয়ে বালু কেটে ক্যানেল না কি বলে সেটা করে দিক।”
মাঝ পদ্মায় দেখা হয় পাবনা জেলার সুজানগর থেকে আসা রবিউল ইসলাম রবিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “নদীর এপার আর ওপারের মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা থাকার কারণে নদী পার হতে হয়। এখন নদীতে চর পড়ে গেছে। যে কারণে যাতায়াতে কষ্ট করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতু করে পাবনা আর কুষ্টিয়া এক করে ঢাকাতে নিয়ে যায় তাহলে দুর্ভোগ কমবে।”
তবে ঘোড়ার গাড়ি দেখে কষ্টের মাঝেই একটু আনন্দও লাগে বলে জানান রবিউল।
খেয়া ঘাটে গিয়ে কথা হয় আসমা খাতুনের সঙ্গে, তিনি বলেন, “ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। ঘাট তো অনেক দূরে বাচ্চারা বালুর মধ্যে হেঁটে আসতে পারবে না তাই ঘোড়ার গাড়িতে দেড়শ টাকা ভাড়া দিয়ে এসেছি।”
আরেক বৃদ্ধ মান্নান মোল্লা বলেন, “ঘোড়ার গাড়ি না থাকলি হাঁঠে কষ্ট করে যাওয়া লাইগতো। ঘোড়ার গাড়ি থেকে একটু সুবিধেই হয়ছে। বালুর মধ্যে হাঁঠে যাতি কষ্টমষ্ট লাগে, ঘোড়ার গাড়িতি দুডে পয়সা বেশি লাগলিও ছাওয়াল পল নিয়ে আরামে যাওয়া যায়।”
ঘোড়ার গাড়ি চালক মফিজ মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আট বছর ঘোড়ার গাড়ি চালাই। এরমধ্যে বালুর চরে গত তিন বছর গাড়ি চালাই। এখানে ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি আছে। প্রতিদিন আমি ছয়টা করে টিপ মারি। তাতে ছয় থেকে ৭০০ টাকা ভাড়া পাই। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার চর পড়ায় আগের মত যাত্রী আসে না। অনেকেই আবার হেঁটেও যায়।”
হাবাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আল মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যারা এই নৌপথ ব্যবহার করে পাবনা বা উত্তরবঙ্গে অথবা পাবনা থেকে রাজবাড়ীসহ আশপাশের জেলায় যাতায়াত করে তারা যদি কুষ্টিয়ার লালন সেতু হয়ে যাতায়াত করেন তাহলে তাদের দেড় থেকে দুইশত কিলোমিটার পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হবে।
বাস্তব কারণে এখনি দুর্ভোগ কমানোর কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, শুষ্ক মৌসুমে এই নৌ-পথ ব্যবহারকারীরা দুর্ভোগের শিকার হয়েই পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন। তবে দুর্ভোগ কমানোর আপাতত কোনো ব্যবস্থা নেই।
“বালুর মধ্যে দীর্ঘ পথ ইচ্ছা করলেও ইট দিয়ে রাস্তা করা যাবে না, অন্যদিকে নদী খনন করে চ্যানেল করলেও সেটা থাকবে না। কারণ হচ্ছে যেটাই করি বর্ষার সময় থাকবে না। বালুর মধ্যে অন্য কোনো গাড়িও চলবে না। এজন্য যাত্রীদের কষ্টের মধ্যে একটু স্বস্তি হলো ঘোড়ার গাড়ি।”
পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তি না থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে মানুষের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কারণ পাড় থেকে খেয়া ঘাট ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সরে যায়।
“এখন এখানে আমাদেরকে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর নিয়ে এখানে জনদুর্ভোগ কমানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কি-না সেটা আমরা অবশ্যই চেষ্টা করবো।
“যদি সুযোগ থাকে আমরা সেটা ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। তারা যদি ভালো মনে করেন তাহলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন,” বলেন এই কর্মকর্তা।