ভুটানের রাজার সফর ঘিরে কুড়িগ্রামে উচ্চাশা

বৃহস্পতিবার অঞ্চলটিতে রাজাকে স্বাগত জানাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2024, 04:30 PM
Updated : 27 March 2024, 04:30 PM

কুড়িগ্রামে ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনের ঘোষণার পর ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের সফরের মধ্যদিয়ে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে।

বৃহস্পতিবার অঞ্চলটিতে রাজাকে স্বাগত জানাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

রাস্তাঘাট, ব্রিজ, এলাকার বিভিন্ন ম্যুরাল সংস্কার, রং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ প্রায় শেষ।

প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ, রাস্তা। ভুটানের রাজার সফর ঘিরে এলাকায় বিরাজ করছে সাজসাজ রব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে লন্ডনে এক দ্বিপক্ষীয় সভায় রাণীর উপস্থিতিতে কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য ভুটানের রাজাকে প্রস্তাব দেন।

এ বিষয়ে তারা সম্মতি জানালে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়কে ধরলা ব্রিজের পূর্বপ্রান্ত মাধবরাম মৌজায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন ১৩৩ দশমিক ৯২ একর খাসজমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে।

এক বছরের মাথায় বৃহস্পতিবার ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থানটি পরিদর্শন করবেন। প্রস্তাবিত এলাকায় তৈরি হয়েছে একটি বিশেষ মঞ্চ। 

বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ পরিদর্শন উপলক্ষে রাজার আগমনকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

জায়গাটি কুড়িগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্টে থেকে আড়াই কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ধরলা নদীর ব্রিজ সংলগ্ন সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মাধবরাম মৌজার অন্তর্ভুক্ত।

বেশিরভাগ এলাকা খাস জমি হওয়ায় সরকারের বিশেষ সুবিধা হবে। এ ছাড়া আশপাশে পর্যাপ্ত জমি রয়েছে যা অধিগ্রহণ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ নেওয়া যাবে।

এই কর্মযজ্ঞকে ঘিরে এলাকার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকরা পাবেন কাজের সুযোগ। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির দ্বার খোলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কুড়িগ্রামবাসী।

এদিকে, খাসজমিতে বসবাস করা মানুষ বলছেন, তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরোধিতা করতে চান না। তবে বাপ-দাদার আমল থেকে বসবাস করা জায়গা ও জমির জন্য ক্ষতিপূরণ চান।

এ নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেছে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, “ভুটান সরকার তাদের নিজস্ব অর্থায়নে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চালু করবে। আমরা এরই মধ্যে ১৩৩ দশমিক ৯২ একর খাসজমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করেছি। পাশে অধিগ্রহণের উপযোগী আরো জমি আছে। প্রয়োজনে তা দেওয়া সম্ভব হবে। এটি চালু হলে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হবে, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিনিময় হবে, দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে।”

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “এ প্রকল্পে ২১১ একর জমির প্রয়োজন হবে। কাজ শুরু হলে আগামী ৩ বছরে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করবে। কুড়িগ্রামের বেকারত্ব নিরসন হবে। মাল্টিপল ডেভেলপমেন্ট হবে। কৃষিভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি হবে। এর পর্যাপ্ত কাঁচামাল এখানে আছে। বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা কুড়িগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।”

তিনি বলেন, “কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে পাল্টে যাবে এই এলাকার জীবনযাত্রা। এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, উপকৃত হবে ভুটানও। আমার বিশ্বাস, এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হলে এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ভুটানও উপকৃত হবে। এ লক্ষ্যে সরকারে সব ধরনের কার্যক্রম চলমান আছে।”

সম্প্রতি ভুটান সরকারের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কুড়িগ্রাম সফর করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটিকে ঘিরে বাণিজ্যিক হাব হওয়ার পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। পাল্টে যাবে এ জেলার দৃশ্যপট।

এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জেলাটিকে উন্নয়নের রোডম্যাপে যুক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

তবে ভুটানের সঙ্গে সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলে ভুটান, ভারতসহ বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

স্বাধীনতা পদকে ভূষিত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, “বর্তমান সরকারের এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এ জনপদের মানুষের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। এ ছাড়া পাশের লালমনিরহাট জেলার পরিত্যক্ত বিমানবন্দর ও ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ আমলে চলাচলকারী রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু করা গেলে শুধু ভুটান নয়, ভারতের সেভেন সিস্টারের জনগণও উপকৃত হবে।

“অর্থনৈতিক অঞ্চলটি কার্যকর করতে গেলে কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চালু করতে হবে। যাতে এই পথ দিয়ে ভারত দিয়ে সহজে ভুটান যাতায়াত করা যায়।”

কুড়িগ্রাম জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ বলেন, “প্রায় এক দশক পর আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশ-ভুটান যৌথ উদ্যোগে জিটুজি ভিত্তিক 'ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল' সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় খুশি কুড়িগ্রামবাসী।

“২০১৫ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের দারিদ্র বিমোচনের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার ঘোষণা দেন। এর দীর্ঘ নয়টি বছর পর আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রতিশ্রুতি। ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য জেলার সোনাহাট স্থলবন্দর ও চিলমারী নৌবন্দর বিশেষ ভূমিকা রাখবে।”

কুড়িগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল আজিজ মনে করছেন, “ভুটান সরকার বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে এই জেলায় ব্যবসার প্রসার ঘটবে; বিনিয়োগ বাড়বে। দক্ষ ও অদক্ষ মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে।”

কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, “অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চালু হলে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ইন্টার্ন কাজের সুযোগ পাবে।”

এদিকে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন শেষে বিকাল ৫টায় কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থল বন্দরে বিজিবি ভুটানের রাজাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে।

পরে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তাকে বিদায় জানাবেন। বন্দরের বিশেষ ইমিগ্রেশন বুথ পার হয়ে ভারতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে রাজা বাংলাদেশে তার চারদিনের সরকারি সফরের ইতি টানবেন। 

আরও পড়ুন

Also Read: কুড়িগ্রামে ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ দেখতে যাচ্ছে ভুটানের প্রতিনিধিদল