সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তের টেকেরঘাট এলাকার দৃষ্টিনন্দন হৃদের পাশে এটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।
Published : 18 Jan 2024, 11:30 PM
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তের টেকেরঘাট এলাকার দৃষ্টিনন্দন হৃদের পাশে ইট-মিসেন্ট দিয়ে তৈরি ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতিবাদের মুখে ভেঙে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, তাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাত বছর আগে হৃদটি বীর বিক্রম উপাধিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নামে নামকরণ করেছিল জেলা প্রশাসন। পরের বছর সেখানে জনপ্রিয় হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি পর্ব হয়। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে সেখানে ইট-রড-সিমেন্ট দিয়ে ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এ নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর সমালোচনা শুরু হয়। পরে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন সেটি ভেঙে অপসারণ করে।
সুনামগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বিকালে বলেন, “এই কাজটির অনুমোদন আমি আসার আগে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে কাজ শুরু হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হলে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কাজ বন্ধ করে দেই। বিকালে নির্মাণাধীন স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।”
ডিসি আরও বলেন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও ‘ইত্যাদি’র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফাগুন অডিও ভিশন এটি নির্মাণ করছিল।
জেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২০১৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব লেকের চারদিকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নামে লাল সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন এবং পর্যটকদের জন্য ‘শহিদ সিরাজ রেস্ট হাউস’ নির্মাণ করেন।
২০১৮ সালে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি পর্ব ধারণ করা হয় লেকের দক্ষিণ মাথায়। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানটিতে ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার অবকাঠামোর কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ালে প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ করেন। পরে সারাদেশেই এর সমালোচনা শুরু হয়।
ফাগুন অডিও ভিশন, জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মকসুদ চৌধুরী বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেন।
ইত্যাদির এক একটি পর্ব দেশের প্রসিদ্ধ পর্যটন এলাকাগুলোতে হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতিকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়। সেসব স্থানে ট্যুরিজম বোর্ড সরকারি খরচে ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ স্থাপনা তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ‘শহিদ সিরাজ লেক’ এ নিজেদের খরচেই রড, সিমেন্ট, ইট, বালু-পাথর দিয়ে শক্ত স্থাপনা নির্মাণে হাত দেয় ট্যুরিজম বোর্ড। এক্ষেত্রে তারা ফাগুন অডিও ভিশনের কাছ থেকেও অনুমতি নেয়। ‘ইত্যাদি’র প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ মামুন সেসব স্থান চিহ্নিত করে দিচ্ছেন।
৮ ডিসেম্বর মামুন ‘শহিদ সিরাজ লেক’ এ এসে অনুষ্ঠানের মঞ্চের স্থানটি দেখিয়ে দেন। এর মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসদু চৌধুরী বদলি হয়ে গেলে কাজটি স্থগিত হয়ে যায়। পরে চলতি সপ্তাহে ট্যুরিজম বোর্ড স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান বলেন, ৫ নম্বর সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরটি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূমিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার কারণে এটি অনন্য একটি সাব-সেক্টর। এই সাব-সেক্টরের বেশিরভাগই গণযোদ্ধা ও গেরিলা ছিলেন।
“কিশোরগঞ্জের ছিলনী গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ছিলেন এমনই একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে সাচনা যুদ্ধে শহিদ হন। পরে তাকে সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। যার দক্ষিণ-পূর্বে টেকেরঘাট খনি প্রকল্পের দৃষ্টিনন্দন লেকটি অবস্থিত।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফাগুন অডিও ভিশনের প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ মামুন মোহাম্মদ বলেন, “এই স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পর্যটন করপোরেশন আমাদের কাছে এসেছিল, সারা বাংলাদেশের যেসব দৃষ্টিনন্দন স্থানে ইত্যাদির মঞ্চ করা হয়েছিল সেসব স্থানে তারা ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ নামে স্থাপনা করবে, এতে আমাদের কোনো আপত্তি আছে কি-না জানার জন্য। আমরা আমাদের অনাপত্তির কথা তাদের জানাই।
“শুনেছি, তারা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই তাদের নিজেদের খরচে এই স্থাপনা করেছিল। এখন প্রতিবাদের মুখে সুনামগঞ্জেরটি ভেঙেও ফেলা হচ্ছে”, বলেন মামুন।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শাহ আবদুল আলিম খান বলেন, “ইত্যাদির শুটিংকৃত কিছু স্থানে আমরা স্থাপনা করতেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন আমাদের বিপণন কর্মকর্তা মো. মহিবুল ইসলাম।”
মহিবুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
পেছনের কথা
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান অভিযোগ করে বলেন, ২০১৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম গোপনে এই লেকটির নাম ‘ডিসি নীলাদ্রি পার্ক’ নাম দিয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের মাধ্যমেই উন্নয়ন কাজের প্রকল্প পাশ করেন। বদলির কারণে তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তারপরে জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব এসে নিয়মমাফিক কাজ হিসেবে এটির উদ্বোধন করেন।
“তখন আমরা তার কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদ’ থেকে স্মারকলিপি দিয়ে এর প্রতিবাদ করি। এবং শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমের নামে সেটি নামকরণের দাবি জানাই। তিনি আমাদের দাবি মেনে নিয়ে, ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নামকরণ করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন। শহিদ সিরাজের নামে দুটি মিনি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে দেন। পাশাপাশি ‘ডিসি নিলাদ্রী লেক’ নামফলকও ভেঙে দেন। এভাবেই শহিদ সিরাজের নামে স্বীকৃতি পায় লেকটি।
টাঙ্গুয়ার হাওর আর মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা টেকেরহাট সারাদেশেই পর্যটকদের জন্য এক অকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। বর্ষাকাল তো বটেই; সারা বছরই এখানে পর্যটকরা আসনে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে। পর্যটকদের অনেকেই টেকেরঘাটের এই হৃদটিকে ‘নীলাদ্রি লেক’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।
তবে এই ‘বাহারি’ নামকরণের পেছনে পর্যটন কেন্দ্রিক কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা এবং এর সঙ্গে জড়িত স্বাধীনতাবিরোধীদের ‘কৌশল’ রয়েছে বলে অভিমত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের।
তিনি বলেন, “এখানে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে যখন ‘ইত্যাদি’র মঞ্চ তৈরি করে শুটিং শুরু হয় তখনও জায়গাটিকে ‘নীলাদ্রি লেক’ বলে অভিহিত করা হয়। তখন আমরা এর প্রতিবাদ করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরে ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নামেই শুটিং করে।
“এখন শুনছি ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নাকি ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ হয়ে গেছে। বিশালাকার কংক্রিটের স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সরকারি খরচে। এটা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে তামাশা, বেইমানি”, বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতা সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, “আন্দোলন করে ‘শহিদ সিরাজ লেক’ নামকরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণের বিরোধীরা নানা মোড়ক সামনে এনে এর নাম বদলাতে চাচ্ছে। ‘ইত্যাদি পয়েন্ট’ তারই ধারাবাহিকতা।”
তিনি বলেন, “এটা অপসারণই যথেষ্ট নয়, এটার তদন্ত হওয়া উচিত। কার মাথা থেকে এমন উদ্ভট চিন্তা এসেছিল সেটা খুঁজে বের করা দরকার।”
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ বলেন, “মূলধারার সাংবাদমাধ্যম এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারে। এই দখলদারিত্বের মাস্টারমাইন্ড কে বা কারা? প্রশাসন কি বুঝে অনুমতি দিয়েছিলো? কিংবা প্রশাসন এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কি আইনগত ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে?”
২০১৭ সালের ৯ অগাস্ট যখন হৃদটির ‘ডিসি নিলাদ্রী পার্ক’ নামকরণ করা হয়েছিল তখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন গবেষক হাসান মোরশেদ।