স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন সেদিনের কিশোর আজকের বয়োবৃদ্ধ মাঈন উদ্দিন।
Published : 12 Nov 2022, 11:25 PM
১৯৭০ সালরে ১২ নভম্বরের জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় নোয়াখালীর সুবর্ণচর। বিপুল পানির তোড়ে তলিয়ে যায় গোটা জনপদ। প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। ভয়াল সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি সেদিন বেঁচে যাওয়া লোকজন।
দিনটি স্মরণে শনিবার সুর্ণচরে স্মৃতিচারণ, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়।
স্মরণসভায় স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন সেদিনের ১৬ বছরের কিশোর আজকের বয়োবৃদ্ধ মাঈন উদ্দিন (৬৯)।
তিনি বলনে, সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বৈরী আবহাওয়ায় থমথমে পরিবেশ। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। বেতারে সতর্কবার্তা ধীরলয়ে বাড়ছে। সন্ধ্যা নাগাদ সেই বার্তা মহাবিপদ সংকেতে রূপ নেয়। তবুও মানুষের মধ্যে সেরকম কোনো তাগিদ দেখা যায়নি।
“উপকূলের কেউ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কেমন ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। হঠাৎ রাতে জোয়ারের শোঁ-শোঁ শব্দ পেতেই দেখি চারদিকে পানি আর পানি। মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে চারদিক। আমার পরিবারে মা-বাবাসহ ৩২ জন সদস্য ছিলেন। সকাল হতে দেখি সবদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ আর লাশ। মানুষ, গবাদি পশু, জীবজন্তুর মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কারো লাশ গাছে ঝুলছে। পরিবারের সবার খোঁজ খবর নিয়ে দেখি আমাদের পরিবারের ১৬ জনই নেই।”
সেই ১৬ জনের খোঁজ আজও পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “আজও সেই স্বজন হারানোর শূন্যতা আর দগদগে ক্ষত ও দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি।”
সেদিন জলোচ্ছ্বাসে লড়াই করে বেঁচে যাওয়া হাজী ফজলুল হকের বয়স এখন ৮০ বছর; স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
“বানের পানি আমার ছয় সন্তানসহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু তছনছ করে দেয় ভায়াল গোর্কি। আশপাশের আত্মীয়-স্বজনদের সলিল সমাধি হয়েছিল। অনেকের লাশ খুঁজে পাইনি। যারা বেঁচে ছিলেন তারা ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছিলেন, গাছের লতা-পাতা খেয়ে বেঁচে ছিলেন মানুষ।”
সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা মিলনায়তনে সুবর্ণচর প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী বাবলু অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মোবারক (৬৮) ও নুর হোসেনও (৬৪) স্মৃতিচারণ করেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলা ও নোয়াখালীতে অন্তত ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকা পরিণত হয় বিরান জনপদে। নোয়াখালী উপকূলের বাটার চর, চর জব্বার, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় এলাকা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়।
আলোচনায় আরও অংশ নেন পূর্ব চরবাটা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ছালেহ উদ্দিন, সৈকত সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মীজানুর রহমান, প্রাণের নির্বাহী পরিচালক নুরুল আলম মাসুদ, দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জাহিদুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মোবারক, সুবর্ণচর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুজ্জামান নিজাম, সিপিপির উপজেলা সংঘঠক আব্দুর রব, চরবাটা খাসের হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অসীম চন্দ্র দাস, শহীদ জয়নাল আবেদন মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শিমুল চন্দ্র দাস, সুবর্ণচর উপজেলা মডেল মসজিদের খতিব ক্বারী মো. আব্দুল মান্নান, শিক্ষার্থী সুলতান বায়েজিদ, সাংবাদিক আবু নাছের মঞ্জু ও জামাল হোসেন বিষাদ।