নরসিংদীতে ছাত্রদল নেতা খুন: অভিযোগের আঙুল খোকনের দিকে

প্রায় চার মাস আগে জেলা ছাত্রদলের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র; এরপর ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন একাংশের নেতাকর্মীরা।

নরসিংদী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2023, 04:17 PM
Updated : 26 May 2023, 04:17 PM

নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের একাংশের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় গুলিতে দুই নেতাকর্মী নিহতের ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।   

তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলা আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। 

বৃহস্পতিবার বিকালে শহরের অস্থায়ী কার্যালয়ের কাছে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে জেলা ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক (৩২) ও আশরাফুল ইসলাম (২০) গুলিবিদ্ধ হন। 

ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাদেকুর রহমান সাদেক (৩২) মারা যান। শুক্রবার সকালে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আশরাফুল ইসলাম (২০)।  

জেলা ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান হাজীপুর ইউনিয়নের বাদুয়ারচর উত্তরপাড়ার প্রয়াত আলাল উদ্দিন মেম্বারের ছেলে। তার মাথায় গুলি লেগেছিল বলে সংগঠনের নেতাকর্মী ও স্বজনরা জানিয়েছেন।   

নিহত আশরাফুল ইসলাম নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাজমুল ইসলামের ছেলে। তার পিঠে গুলি লেগেছিল বলে নেতাকর্মীরা জানান। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই দুজনই মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় অগ্রভাগে ছিলেন। হামলাকারী মাস্কপরা ৮/১০ জনের বেশিরভাগের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। 

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারী জেলা ছাত্রদলের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। এরপর থেকে এই কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন সংগঠনের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। 

নতুন কমিটি থেকে বহিষ্কৃত এবং পদবঞ্চিতদের পক্ষের নেতা মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বে এই মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের হয়। এতে অন্তত ৫০টি মোটরসাইকেলে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। শহরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পার হয়ে বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল শোভাযাত্রাটি। এ সময় হঠাৎ গুলি করা হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানান, নতুন কমিটিতে মাইন উদ্দিন ভূঁইয়াকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি করা হলেও তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক প্রত্যাশী। তাই তিনি পদবঞ্চিতদের নিয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন। এ কারণে তাকেসহ তিন নেতাকে সংগঠন থেকে স্থানীয়ভাবে বহিষ্কার করা হয়। 

সাদেকুরের মাথায় এবং আশরাফুলের পিঠে গুলি লাগে বলে সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। 

নাম প্রকাশ না করে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার পর শোভাযাত্রার অন্য নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কেউ কেউ মোটরসাইকেল ফেলে প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে যান। ওই সময় গুলিবিদ্ধ দুজন মোটরসাইকেলসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে হামলাকারীরা দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে এবং অন্তত পাঁচজনকে পিটিয়ে আহত করে চলে যায়। 

পরে উপস্থিত লোকজন ও শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া কয়েকজন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ দুজনসহ আহতদের উদ্ধার করে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেন। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সাদেকুর ও আশরাফুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। 

এদিকে, সাদেকুরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ হামলার বিচারের দাবিতে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে বৌয়াকুড় মোড়ে এসে শেষ হয়। 

এর কিছুক্ষণ পরেই জেলা বিএনপির সদস্য ও হাজীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক। 

ছাত্রদলের নতুন কমিটির বহিষ্কৃত নেতা মাইন উদ্দিন ভূইয়া বলেন, “খায়রুল কবির খোকন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশ করে নরসিংদী জেলা কমিটিতে চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী, ইভটিজার ও ছিনতাই মামলার আসামি দিয়ে কমিটি গঠন করে সংগঠনকে কলংকিত করেছেন। এটি তৃণমূল ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করে খায়রুল কবির খোকনকে নরসিংদীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। 

“সেই ক্ষোভ থেকে খায়রুল কবির খোকনের নির্দেশে এক নেতার নেতৃত্বে ছাত্রদলের তৃণমূলের প্রাণ সাদেক ও আশরাফুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়।” 

এ ব্যাপারে কথা বলতে জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মোবাইলে ফোন করে তা বন্ধ পাওয়া যায়। 

তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজের ফেইসবুকে দুটি ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখানে লেখা, ‘২৭ তারিখে বিএনপির সমাবেশ সফল করার জন্য ঢাকা নয়া পল্টনে মহানগর বিএনপির অফিসে নরসিংদী জেলা বিএনপির যৌথ সভা। পল্টনে সভা চলাকালীন সময়ে জানতে পারলাম পূর্বের ন্যায় সরকারের এজেন্টরা ২৭ তারিখের সমাবেশ পন্ড করার জন্য চিনিশপুরে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে গন্ডগোল করেছে। যে কোনো মূল্যে কাউরিয়াপাড়া পৌর ঈদগাহ মাঠে সমাবেশ সফল করতে হবে।’ 

অভিযোগের ব্যাপারে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন বলেন, “জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকে পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা আমাদের ওপর ও জেলা বিএনপির কার্যালয়ে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে। এখন তারা নিজেরা নিজেরাই এসব ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে বলছে।” 

এ ব্যাপারে শুক্রবার বিকালে নরসিংদী সদর মডেল থানার ওসি আবুল কাসেম ভূইয়ার সরকারি নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। 

পরে থানার ডিউটি অফিসারের নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এসআই কামরুজ্জামান বলেন, “এখনও পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। গ্রেপ্তারের বিষয়টি সিনিয়র স্যারেরা বলতে পারবেন।” 

নিহতের স্বজনরা জানান, শুক্রবার সকালে সাদেকুর রহমানের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। বিকালে নরসিংদী সদরের বাদুয়ারচর মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত 

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি জেলা ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। 

দীর্ঘ ১২ বছর পর ঘোষিত ওই কমিটিতে সিদ্দিকুর রহমান নাহিদকে সভাপতি, মাইন উদ্দিন ভূঁইয়াকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মেহেদী হাসান রিফাতকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী ছিলেন মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া। প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় তার কর্মী সমর্থকরা আন্দোলন শুরু করেন। 

২৬ জানুয়ারি রাতেই ২০/২৫ জন যুবক জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে শতাধিক প্লাস্টিকের চেয়ার, ব্যানার, প্রচারপত্র ও ফেস্টুনে আগুন লাগিয়ে দেয়। ইটপাটকেল ছুড়ে কার্যালয়ের জানালা ও সিঁড়ির গ্লাস ভাঙচুর করে। 

এরপর ৩০ জানুয়ারি বিকালে ওই স্থানেই খায়রুল কবির খোকনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে একদল যুবক। 

ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে পদবঞ্চিতরা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন। 

১১ ফেব্রুয়ারি সকালে শিবপুরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ইটাখোলা মোড়ে খায়রুল কবির খোকনের গাড়িবহরে গুলি ও ককটেল হামলার ঘটনাও ঘটে। 

এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিটির সহসভাপতি মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া, সাদেকুর রহমান সাদেক ও ফাহিম ভূঁইয়া রাজ অভিকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। 

এরপর গত ৫ এপ্রিল বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে হামলা হয়। ওই সময় একের পর এক হাতবোমার বিস্ফোরণ ও ইটপাটকেল ছুড়ে কার্যালয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে হামলাকারীরা। 

সর্বশেষ ২০ মে আবার ইটপাটকেল ছুড়ে কার্যালয়ের কাচ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।