কুমিল্লা নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘিরে দলের বিরোধ প্রকাশ্যে

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর প্রথম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি হয় ২০১৭ সালে; কিন্তু সে সময় সম্মেলন হয়নি।

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2022, 05:20 PM
Updated : 4 Nov 2022, 05:20 PM

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ২০১৭ সালের ২২ জুলাই প্রথম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হলেও সে সময় সম্মেলন হয়নি।

প্রথমবারের মতো কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শনিবার।

এতদিন দলের মধ্যে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য না থাকলেও সম্মেলনকে ঘিরে এরই মধ্যে নগর আওয়ামী লীগের চিরচেনা দুটি পক্ষ আফজল ও বাহার অনুসারীদের বিরোধ স্পষ্ট হয়।

দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, সম্মেলনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে দুই পক্ষের পুরোনো কোন্দল আর দ্বন্দ্ব বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক সম্মেলন নিয়ে একদিকে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দ-উদ্দীপনা বিরাজ করলেও কেউ কেউ করছেন সংঘর্ষের আশঙ্কা।

দলের অন্তত দশজন নেতাকর্মীরা জানান, কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক বিরোধ চলেছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের।

আফজল খানের মৃত্যুর পর তার মেয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আঞ্জুম সুলতানা সীমা এখন ওই পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

পাশাপাশি সীমার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ও কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরানও রাজনীতিতে বাবার ধারা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করছেন। এমপি বাহারের সঙ্গে বাবার মতোই তাদের সেই পুরোনো রাজনৈতিক বিরোধ চলে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে এমপি বাহারের নেতৃত্বাধীন মহানগর আওয়ামী লীগ। প্যান্ডেল করা থেকে শুরু করে ডেলিগেটদের দাওয়াত দেওয়ার পর্বও শেষ হয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর এমপি বাহার ও আফজল খানের মেয়ে সীমা পৃথকভাবে প্রস্তুতি সভা করেছেন। সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রয়াত আফজল খানের অনুসারীদের উপেক্ষিত করার অভিযোগ করেছেন তারা।

তবে বাহারের অনুসারীরা তা নাকচ করে দিয়েছেন।

এই দুটি পক্ষের উত্তেজনার মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে বলে শঙ্কা নগরীর বাসিন্দাদের।

দলীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার [৫ নভেম্বর] কুমিল্লা টাউন হল মাঠে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সম্মেলন উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধান বক্তা হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ।

সম্মেলনে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সভাপতিত্ব করবেন বলেও কর্মসূচিতে জানানো হয়।

এরই মধ্যে বাহারের অনুসারী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আরফানুল হক রিফাতকে আহবায়ক করে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হয়েছে।

সম্মেলনকে ঘিরে নগরজুড়ে বাহার অনুসারীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। সম্মেলন সফল করতে নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এরই মধ্যে সম্মেলনের জন্য কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বিশাল প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে।

গত ৩০ অক্টোবর ওই প্যান্ডেলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুমিল্লা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন।

শনিবারের সম্মেলন নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, সম্মেলনকে ঘিরে দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ, উল্লাসিত ও উজ্জীবিত। তিনি ঘুরে দেখেছেন নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কমীরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সম্মেলন সফল করতে। মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন একটি উৎসবে পরিণত হবে বলে আশা করছেন তিনি।

তবে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে প্রয়াত আফজল খানের অনুসারীদের মধ্যে।

আফজল খানের মেয়ে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, “৫ নভেম্বরের সম্মেলনের বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। সম্মেলনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি সভায় আমাদের কাউকে রাখা হয়নি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে।”

কেন ডাকা হয়নি প্রশ্নের জবাবে সীমা বলেন, “সেটা ওনারা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি সম্মেলনে যাব; কারণ আমি আওয়ামী লীগেরই একজন কর্মী। সেখানে কেউ বাধা দিলে তখনকারটা তখন দেখা যাবে।”

সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক কুমিল্লা সিটি মেয়র আরফানুল হক রিফাত বলেন, “পত্রিকায় প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সম্মেলনের বিষয়ে জানানো হয়েছে। এটা কোনো জনসভা নয়, এটা সম্মেলন। সেখানে কাউন্সিররা আসবেন, ভোট দিবেন। লুকোচুরির কিছু তো এখানে হয়নি। এখন কেউ যদি দাওয়াতের বিষয়টি অস্বীকার করেন তাহলে আমরা কী করতে পারি?”

শনিবারের সম্মেলনের সবশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রিফাত বলেন, “আমাদের সম্মেলনের প্রস্তুতি খুবই ভালো। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডেই আমরা মিটিং করেছি। সর্বত্র নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ দেখেছি। ৫ নভেম্বর সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় একটা সফল-সার্থক সম্মেলন আমরা উপহার দেব, ইনশা-আল্লাহ।”

বাহারের অনুসারী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি জহিরুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আমাদের সম্মেলনের প্রস্তুতি খুবই ভালো। ২৭টি ওয়ার্ডেই আমরা মিটিং করেছি। একটি সফল সম্মেলন অনুষ্ঠান হবে আশা করছি।”

আফজল অনুসারীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ তো ওদের নিজেদেরই দল। মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয় তো ওদেরই ঘর। তারা নিজের ঘরে নিজে আসবে না কেন? তাদের দাওয়াত দিতে হবে কেন?”

মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, “আমি সম্মেলনের বিষয়ে কিছুই জানি না। সম্ভবত আমাদের (আফজল অনুসারী) কেউই কিছু জানেন না। কারও বাড়িতে কেউ দাওয়াত না দিলে কি জোর করে যাওয়া যায়?”

মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক নুর-উর-রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, “কোনো সমন্বয় সভায় আমাদের ডাকা হয়নি। তবুও ঘরে বসে থাকব না। দলের একজন কর্মী হিসেবে সম্মেলনে অবশ্যই যাব। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসবেন, তাদের শুভেচ্ছা জানাব। আর আমাদের উপেক্ষা করার বিষয়টি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতারা অবগত আছেন।”

মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, আওয়ামী লীগ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। কোনো একজন ব্যক্তির কাছে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগকে ইজারা দেওয়া হয়নি।

“আমরা সম্মেলনে অবশ্যই যাব। কেউ বাধা দিয়ে সম্মেলন বিশৃংখলা করার চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত করা হবে।”

মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক কবিরুল ইসলাম শিকদার বলেন, “সম্মেলনে না রাখার উদ্দেশ্য হলো আমাদের শেষ করে দেওয়া। দলের দুঃসময়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। আমি দলের কর্মী। সুতরাং সম্মেলনে আমি থাকবই।”

সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি যুগ্ম-আহবায়ক মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন বলেন, তারা (আফজল অনুসারী) কয়েকজন ঘরে বসে অভিযাগের বাক্স খুলে রাখেন। আমার ঘরে আমি যাব, সেখানে দাওয়াতের কি আছে? এসব খোঁড়া যুক্তি বাদ দিয়ে তারা কিছু একটা করে দেখাক। সম্মেলনের আয়োজন তো তারা নিজেরাই করতে পারত। তা না করে ঘরে বসে বসে অভিযোগ করছেন। সম্মেলনের ব্যাপারটি পত্রিকায় স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগ অফিসে এসে যদি ওই গ্রুপের কেউ অপমানিত হতেন তাহলে অভিযোগ করতে পারতেন। এখন সম্মেলনকে সামনে রেখে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তারা।