সুনামগঞ্জের গুঙ্গিয়ার গাঁওয়ের এক নিশ্চিহ্ন বধ্যভূমি

নিশ্চিহ্ন হওয়া একটি বধ্যভূমি রয়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লার গুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে, যেটার খবর আজকের প্রজন্মের প্রায় কেউ জানে না।

শামস শামীমসুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2022, 03:37 AM
Updated : 13 Dec 2022, 03:37 AM

আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে অর্ধ শতাব্দী আগে। যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় হত্যা করেছে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ। কোনো কোনো স্থানে করেছে গণহত্যা; দেওয়া হয় গণকবর। দেশে কয়েক হাজার বধ্যভূমি থাকলেও চিহ্নিত হয়েছে কয়েকশ মাত্র। কোনো কোনো বধ্যভূমি চিহ্নিত হলেও চরম অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে।

এমন একটি অবহেলিত বধ্যভূমি রয়েছে সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর উপজেলা শাল্লার ‘গুঙ্গিয়ার গাঁও’ এলাকায়। সেই বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন আজ নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধারা জানান, আজকের যে দোতলা থানা ভবন সেটাসহ থানা চত্বরের আশপাশে একাত্তরে হানাদার-মিলিশিয়ারা নির্যাতন ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। সুরক্ষিত বাঙ্কারের সঙ্গে ছিল একাধিক নির্যাতন সেল। নারী-পুরুষসহ নিরীহ কতশত মানুষকে নির্যাতন করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনেও নির্যাতন করত হানাদাররা। হত্যার পর বাঙালিদের একসঙ্গে মাটিচাপা দিয়ে রাখত হানাদারেরা।

রক্ষিত না হওয়ায় স্বাধীনতার এতকাল পর সেই বধ্যভূমির চিহ্নটুকু আর নেই।

এই বধ্যভূমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তাদের ভাষায় উঠে এসেছে সে সময়ের কথাগুলো।

শাল্লা উপজেলা সদর গুঙ্গিয়ার গাঁও হাওরঘেরা এক প্রত্যন্ত জনপদ। একাত্তরে যুদ্ধের সময় বর্ষায় নৌকা ছাড়া সেখানে পৌঁছানোর কোনো পথ ছিল না। হেমন্তে হাওরের জাঙ্গাল ধরে যেতে হয়। এখনও সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। একটি কথা প্রচলিত আছে – বর্ষায় নাওয়ে আর হেমন্তে পাওয়ে হেঁটে যেতে হয় গুঙ্গিয়ার গাঁও। এই এলাকায় স্বাধীনতার আগে অন্তত ৮০ ভাগের বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এখন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের ভয়ে জীবন নিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন কত মুক্তিযোদ্ধা।

এখনও স্বাধীনতা বিরোধীদের ভয়ে পরিচয় গোপন করে জীবনযাপন করছেন সুকুমার দাস নামের এক যুদ্ধজয়ী বীর। তিনি টেকেরঘাট সাব সেক্টরের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও কম্পানি কমান্ডার ছিলেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি-সুকুমার দাস-সালেহ চৌধুরী হানাদারদের এই দুর্গ ভেঙে দিতে একাধিকবার আক্রমণ করেছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণরা জানান, গুঙ্গিয়ার গাঁও থানা ভবন ছিল হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী একটি ক্যাম্প। আজমিরিগঞ্জ ও গুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে অবস্থানরত হানাদার মিলিশিয়ারা নাশকতা চালাত এলাকায়। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালাত।

এখানকার সবাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। গুঙ্গিয়ার গাঁওসহ আশপাশের অনেককেই হত্যা করে বর্তমান থানা ভবনের নিচে গর্ত করে মাটিচাপা দিয়ে রাখত।

৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবসের পর যখন যুদ্ধজয়ী বীরের গুঙ্গিয়ার গাঁও প্রবেশ করেন তখন তারা থানা ভবনের আশপাশে অনেক মানুষের হাড়গোড় দেখতে পান। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়া হাড়গোড় আবার গর্তে চাপা দিয়ে রাখা হয়।

১৯৭২ সনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা চৌধুরীসহ অনেকে গুঙ্গিুয়ার গাঁও থানার বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলেন।

এর মধ্যে ১৯৭৫ সনে জাতিরজনক ও তার পরিবারকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বধ্যভূমি সংক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব ধারনের সক্রিয়তা উপেক্ষিত ও বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে দীর্ঘ সময়ের অবহেলায় দেশের অন্যান্য বধ্যভূমির মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গুঙ্গিয়ার গাঁও বধ্যভূমির চিহ্ন। এখন বেশিরভাগ মানুষ জানে না বধ্যভূমির কথা। বিশেষ করে এই অঞ্চলের নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে কিছুই জানে না।

সুখলাইন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ চন্দ্র সরকার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের মোক্তারপুর সাব সেক্টরের যোদ্ধা।

তিনি বলেন, বিজয়ের পর তিনি বাড়ি এসে গুঙ্গিয়ার গাঁও থানা এলাকা ও ডুমড়া আখড়া এলাকার তাণ্ডবের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করেন। থানা ভবনের টর্চার সেলের আশপাশে অসংখ্য হাড়গোড় দেখতে পান। স্থানীয়দের নিয়ে সেই হাড়গোড় মাটিচাপা দেন।

১৯৭২ সালে আব্দুস সামাদ আজাদসহ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খান এলে বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানানো হয়েছিল বলে তিনি জানান।

স্বাধীনতার পর এখানে থানার আবাসিক ও অনাবাসিক স্থাপনা করার পর ভয়ে কেউ অবস্থান করতে চাইত না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা প্রবীণ ও স্থানীয় তারা এসব বিষয় এখনও জানেন; কিন্তু বধ্যভূমির বিষয়ে নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না।

বধ্যভূমির পার্শবর্তী বাহাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবধন দাস ৪ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন; যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে আসেন। তখনও যুদ্ধের ক্ষত দগদগে ছিল। থানা ভবনের আশপাশে পাকিস্তানি হানাদার-মিলিশিয়া-রাজাকারদের নাশকতার চিহ্ন ছিল।

শিবধন দাস বলেন, “গুঙ্গিয়ার গাঁও থানা ভবন ছিল হানাদারদের ক্যাম্প। পুরো থানা ভবন এলাকাই ছিল নির্যাতন সেল। বহু নিরপরাধ মানুষকে খুন করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কতশত মানুষ এখানে এসে চিরতরে হারিয়ে গেছে তার হিসাব নেই। এই বধ্যভূমি রক্ষা করতে না পারা ও কোনো সৌধ তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য দায়ী আমরাও।”

বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, তার বাবা ও প্রবীণরা জানিয়েছেন একাত্তরের গুঙ্গিয়ার গাঁও থানা এলাকা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ভয়ে এখানে কেউ ঘুমাত না। একাত্তরের তরতাজা স্মৃতি হারিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম জানে না এই বধ্যভূমির কথা।

এই বধ্যভূমি বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব কিছু জানেন না বলে জানান।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শুধু গুঙ্গিয়ার গাঁওই নয় এই উপজেলার দৌলতপুর ও দিরাই উপজেলার শ্যামারচর বধ্যভূমির স্মৃতিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।