৫ অগাস্ট ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন ঝালকাঠির সুজন খান; পরিদিন তিনি ঢাকা মেডিকেলে মারা যান।
Published : 31 Mar 2025, 09:06 AM
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকায় নিহত হন ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার সুজন খান। তার স্ত্রী জান্নাত আক্তারের গর্ভে তখন দ্বিতীয় সন্তান। আড়াই মাস আগে জন্ম হয়েছে সেই ছেলে সন্তান আবদুল্লাহর।
জান্নাত আক্তার আফসোস করে বলছিলেন, জুলাই আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তার স্বামী নিহত হলেও তার ছেলেকে কেউ শুভেচ্ছা জানাতে আসেনি। কোনো সরকারি দপ্তর থেকে একটি ফুলও জুটেনি তার ছেলের ভাগ্যে।
“ঝালকাঠিতেই আরেকজন শহীদের সন্তানের মতই আমার নবজাতকসহ দুই সন্তানের বড় হওয়া পর্যন্ত খরচের দায়িত্ব যদি কেউ নিত তাহলে একটু স্বস্তি পেতাম। অন্তত কেউ আমার সন্তানটাকে একটু দেখতে আসলেও আমার স্বামী সম্মানিত হতেন।”
জান্নাত আক্তার বলছিলেন, তার সংসারের চাকা কোনোমতে চলছে। যেহেতু পরিবারে কোনো উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই, ফলে শ্বশুরবাড়ির সহায়তায় চলছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর এটাই প্রথম ঈদ। তিন বছরের মেয়েটি বাবার কথা মনে করতে পারে কিন্তু আড়াই মাসের শিশু কোনোদিন আর বাবার স্পর্শ পাবে না। সুজন নেই, পরিবারের কোনো ঈদ-আনন্দও নেই।
কে এই সুজন?
ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার কৈখালীর বাবুল খান (৬২) ও দুলিয়া বেগমের (৫৫) ছেলে সুজন খান (৩০)। পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীর কেরানিগঞ্জে। ইসলামপুরে একটি কাপড়ের দোকানে তিন ভাই একসঙ্গে কাজ করতেন। অন্য দুই ভাই হলেন- সুমন (৩৩) ও সাগর (২৮)।
তাদের বড়ভাই রুবেল খান (৩৬) গ্রামের বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়িতেই থাকেন। ছোটবোন সুমী আক্তার (২২) বিবাহিত। পরিবারের তৃতীয় সন্তান সুজন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
দুলিয়া বেগম জানান, পেটের দায়ে প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় যান তার ছেলে। এক পর্যায়ে তার তিন ছেলে ও স্বামীর সঙ্গে তিনিও ঢাকার কেরানিগঞ্জে থাকতে শুরু করেন। ২০২১ সালে সেজ ছেলে সুজন আবদুল মালেক সরদার ও পিয়ারা বেগমের মেয়ে জান্নাত আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পেশায় ইজিবাইক চালক মালেক সরদার পরিবার নিয়ে কেরানিগঞ্জে ভাড়া বাসায় একই জায়গায় থাকলেও তার বাড়ি শরীয়তপুরে। ২০১৭ সালে দাখিল (এসএসসি সমমান) পাস করেন সুজনের স্ত্রী জান্নাত।
এই দম্পতির প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয় ২০২২ সালের ২১ অগাস্ট। মেয়ের নাম রেখেছিলেন নুসরাত জাহান নূর। নূরের বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে সুজনের মৃত্যু হয়। জান্নাত এখন দুই সন্তানকে নিয়ে কেরানিগঞ্জের হাজিবাড়ি এলাকায় শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গেই থাকেন।
‘সন্তান বাবার স্পর্শ পাবে না’
সুজন খান ৫ অগাস্ট প্রতিদিনের মতো কাজে বের হয়েছিলেন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। ছুটি হওয়ার কথা সন্ধ্যা ৭টায়। রুটিন অনুযায়ী রাত সাড়ে ৯টায়ও বাসায় ফেরেননি। সঙ্গে থাকা ফোনটিও ছিলো বন্ধ।
রাত ১২টায় সুজনের ফোনটি চালু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক পরিবারকে জানান আহত হওয়ার কথা। পরদিন ৬ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টায় একই হাসপাতালে মারা যান সুজন।
সকালে যখন বাসা থেকে সুজন বের হয়েছিলেন, স্ত্রী জান্নাত আক্তার স্বামীকে শেষ কথা এটুকুই বলেছিলেন- ‘তাড়াতাড়ি বাসায় এসো’। সুজনের স্ত্রী তখন সাড়ে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
সুজনের স্ত্রী জান্নাত আক্তার বলেন, “আমার স্বামী ৫ অগাস্ট সকাল সাড়ে ১০টা বা ১১টার দিকে দোকানের মালামাল আনার কথা বলে যাত্রাবাড়িতে আন্দোলনে যোগ দেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন। রাত ১২টার পরে আমরা জানতে পেরে সবাই হাসপাতালে যাই। পরের দিন বিকালে তো আমার সন্তানদের এতিম করে সে চলেই গেল।”
১৩ জানুয়ারি পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে পুত্র সন্তান জন্ম দেন জান্নাত। নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ।
জান্নাত আক্ষেপ করে বলেন, “আমার এই সন্তানটা বাবার স্পর্শটুকুও পাবে না। আমার নিজের বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ি সবারই অভাবের সংসার। জুলাই ফাউন্ডেশনের দেওয়া পাঁচ লাখ টাকার সাড়ে তিন লাখ টাকা আমার সন্তানদের জন্য পেয়েছি। আমার সম্মতিতেই শ্বশুর-শাশুড়িকে দেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা।
“জামায়াতে ইসলামীর দেওয়া দুই লাখ টাকার বেশির ভাগই খরচ হয়েছে স্বামীর চিকিৎসা, লাশ গ্রামে আনা ও দাফন বাবদ হওয়া ঋণ শোধ করতে। সন্তানকে গর্ভে নিয়েও ভালো কিছু খাওয়ার জন্য হাতের অবশিষ্ট টাকা থেকে খরচ করিনি দুইটা ছোট বাচ্চার ভবিষ্যৎ ভেবে। এখন আমাদের তিনটি পেট কতদিন শ্বশুর-শাশুড়ি চালাবে?”
তিনি বলেন, “পরিবারে এক মেয়ে থাকতেই আমার স্বামী বলত, দোকানের চাকরির পাশাপাশি নতুন কিছু করব। কিন্তু সে আমারে দুই সন্তান আর তার নতুন কবর উপহার দিয়ে গেল। যে দেশের জন্য আমার সন্তানরা এতিম হলো সেদেশের কেউ ছোট সন্তানটা জন্ম নেয়ার পর একটু ফোন দিয়েও খোঁজ নেয়নি।”
সুজনের মা দুলিয়া বেগম বলেন, “৬ অগাস্ট বিকালে হাসপাতালে বইয়া আমার বাবায় পানি চাইছিলো। হাতে গ্লাস ধইরা নিজেই খাইছে। নিজেই কইছে, আমি আর বাঁচবো না। খালি জিগাইছে- মা, আর রক্ত দেবে না? কইছি বাবা, দুই ব্যাগ দেওয়া অইছে; আরও দুই ব্যাগ আনা অইছে; এহনই দেবে। কিন্তু হেই দুই ব্যাগ দেওয়ার আগেই বাবায় আমার কোল খালি কইরা চইলা গেছে। বাবায় গ্রামের বাড়ি যাইয়া কিছু একটা করতে চাইতো। এহন আজীবনের লইগ্গা বাড়ির সামনে ঘুমাইতে আইছে।”
শরীরজুড়ে ১১০ গুলি
বড়ভাই রুবেল খান বলেন, “বাড়িতে দাফনের আগে আমরা সুজনের শরীরে গুনে গুনে ১১০টা ছররা গুলির চিহ্ন পেয়েছি। এ ছাড়া একটা বড় গুলি এপাশ-ওপাশ ছিদ্র করেছিলো ওর শরীর।”
তিনি বলেন, “ঘটনার এক মাস আগে আমি ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসি। ওর মৃত্যুও ৭-৮ দিন আগেও ফোনে বলছে, ভাই, আমি কিছু টাকা দিমু, তুমিও কিছু দিবা। দুইজন মিল্লা একটা মাহিন্দ্রা কিনমু। গ্রামে আইয়া ওইডা ভাগে চালাইয়া সংসার চালামু।”
সুজনকে দাফন করা হয় ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার কৈখালীতে নিজবাড়ির প্রবেশমুখে খালপাড়ে।
সুজনের বাবা বাবুল খান বলেন, “আমি আছি বলে ছেলের বউ আর বাচ্চাদের কোনোমতে খরচ চালাতে পারছি। কিন্তু আমি বয়স্ক মানুষ আর কতদিন পারবো! আমার স্ত্রীরও ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তিনটা কেমোথেরাপি এখন পর্যন্ত মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে দিয়েছি। প্রতিটির খরচ ১২ হাজার টাকা।
“কয়েকদিন আগে ঝালকাঠি জেলা জামায়াতের আমির ১০ হাজার টাকা দিয়েছে ঈদের খরচের জন্য। কিন্তু এই টাকা তো সুজনের মায়ের কেমোথেরাপিতেই চলে যায়। কাঠালিয়া উপজেলা থেকে রমজানের শুরুতে ইফতার সামগ্রি দেওয়া হয়েছিলো আমাকে।”
সুজনের পরিবারের ব্যাপারে জানতে চাইলে কাঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম বলেন, “সুজনের স্ত্রী তার বাচ্চা প্রসবের চার মাস আগে ঢাকায় চলে যান। সেই অনুযায়ী সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে বাচ্চা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি ডেলিভারির দু’মাস পর।”
জেলা প্রশাসককে ফলোআপ জানানোর কোনো নির্দেশনা ছিলো কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সবকিছু ডিসি স্যারের নির্দেশনা মোতাবেকই হয়, আর সময়মতো জানলেও আমরা কী করতাম?”