Published : 02 Apr 2025, 12:34 AM
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বারান্দায় পা রাখতেই যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, তারপর জীবনের আরও ২৫ বছর পেরোলেও সেই সম্পর্কে ছেদ পড়েনি একটুও। সুযোগ হলেও তারা একত্রিত হন; এবার ঈদে সেই সুযোগ আবার এল।
কর্মজীবনের ব্যস্ততায় সময় বের করার ফুরসত না মেলায় ঈদের ছুটিতে যখন খানিকটা সময় পাওয়া গেল, তখন বন্ধু ও তাদের স্ত্রী-সন্তানদের এক সঙ্গে ঘুরতে আসা হল মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায়।
বলছিলাম রাজধানীর অন্যতম এ দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে আসা তমালের কথা। ঈদের পরের দিন মঙ্গলবার তিনি, তার দুই বন্ধু, তাদের স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের দেখা মিলল একসঙ্গে।
মিরপুরের কচুক্ষেত থেকে তমালকে যানজট ঠেলে চিড়িয়াখানায় ঢুকতে হয়েছে। এখানে ভিড়ের অস্বস্তি। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্ধুরা মিলে ঘুরতে আসলাম আমরা। সারাবছর তো এমন ঘোরা হয় না। আজকে একটু প্ল্যান করে বের হওয়া হইল।
“এসে তো বিপদে পড়ে গেলাম। যেই পরিমাণ জ্যাম। যেই খারাপ অবস্থা। কষ্ট হচ্ছে ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে। তারপরও যতটুকু পসিবল ইনজয় করা সম্ভব, আমরা করতেছি।”
তিনি বলেন, তাদের বন্ধুত্বের শুরু কেজিতে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাপল্লী হাই স্কুলে একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলেন তারা। এ স্কুল থেকে ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেছেন। এরপর কলেজ ভিন্ন হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব অটুট ছিল আগের মতই।
“আমরা তিন ফ্রেন্ড, একদম কেজি থেকে একসাথে পড়েছি। আর আমাদের বন্ডিং এখনও আছে। আমাদের ওয়াইফ, আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছি,” বলছিলেন তমাল।
তমালদের সঙ্গে যখন কথা হয় তারা তখন কেবল ঘুরাঘুরি শুরু করেছেন। বললেন, “ঘোরা শুরু করলাম আরকি! জ্যাম ছিল তো, যতটুকু পসিবল এখন পারা যায়।”
চিড়িয়াখানার ভেতরে দর্শনার্থীদের ভিড় নিয়ে বিরক্তি ছিল অন্যদের মধ্যেও। তবে দর্শনার্থীদের ঘুরে বেড়াতে এই ভিড় বাধা হতে পারেনি।
মিরপুর চিড়িয়াখানায় সরেজমিনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। শহরের যান্ত্রিকতা, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে খানিকটা সময় প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে কাটাতেই তাদের এখানে ছুটে আসা।
এর রেশ রাস্তায়ও পড়েছিল। মিরপুর-১ এর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে রায়েনখোলা মোড় হয়ে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। পাশের ময়লার ভাগাড়ের উৎকট গন্ধে নাক চেপেই এ পথ হেঁটে চিড়িয়াখানা পৌঁছেছেন দর্শনার্থীরা।
বেশিরভাগই এসেছেন সপরিবারে। যাদের শিশু সন্তান রয়েছে তাদের ঝোঁক থাকে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা। হাতি, জিরাফ, গণ্ডার, সিংহ ও বাঘের সঙ্গে সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতেই মা-বাবাদের আসা ঢাকার এই জাতীয় চিড়িয়াখানায়।
২০২১ সালে এক সঙ্গে জন্ম নেওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার বর্ষা ও ছায়ার খাঁচার সামনেই মৃদু স্বরে বাঘের গর্জনের অনুকরণ ৭ বছরের শিশু ফাতেমাকে। বাবার সঙ্গে শাহিনবাগ থেকে এসেছে সে।
বাঘের সঙ্গে দূর থেকে খেলা করে কেমন লাগল জানতে চাইলে ফাতেমা ‘ভালো’ বলেই একাই লাফিয়ে উঠল খুশিতে।
খুবই ভালো লাগল কিনা ফের প্রশ্ন করলে বলল, “এই মাত্র তো দেখে ভালো লাগল।”
সেখানেই কথা হয় এক দম্পতির সঙ্গে। ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এসেছেন উত্তরা থেকে। বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, বানরসহ অনেক প্রাণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তাদের বাসায় ফেরার তাড়া দিচ্ছিলেন।
কিন্তু ছেলে আহনাফ বাবাকে বলছিল, “না বাবা, চল। এখনই যাব না আমি। ওইটা (আফ্রিকান সাদা সিংহের খাঁচা দেখিয়ে) দেখব। নিয়ে চল।” বলেই বাবার হাত ধরে টানাটানি শুরু।
চিড়িয়াখানা থেকে বের হতে হতে দেখা হয় গাজীপুরের চেরাগআলী থেকে আসা বিল্লাল হোসাইন, তার স্ত্রী ও চার সন্তানের সঙ্গে।
তার স্ত্রী বলছিলেন, “সব বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আসছি। বাঘ, সিংহ, হরিণ দেখলাম। ওদের (বাচ্চাদের) খুবই ভালো লেগেছে।”
তবে ভিড়ের জন্য ‘বিপদ’ হয়ে গেল বলে বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি।
দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ের কথা শোনা গেল জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদারের মুখেও। একটা আনুমানিক হিসাব দিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এক লাখ ৮০ হাজারের মত। গতকালের টিকিট বিক্রির হিসাবে দর্শনার্থী ছিলেন তার অর্ধেকেরও কম, ৭০ হাজারের মত।”
দিনের কোন সময়টা বেশি ভিড় জমিয়েছেন দর্শনার্থীরা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আজকে সারাদিনই মানুষের চাপ। তবে সকাল ১১টা থেকে ১২টায় একটা অনেক বড় প্রেশার ছিল। আবার ২টা থেকে ৩টা, সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বড় প্রেশার ছিল। সারাদিনই আসলে মানুষের প্রচুর চাপ।”
গতবছরের টিকিট বিক্রির তথ্য চাইলে পরিচালক বলেন, “গতবছরের তুলনায় ঈদের দিন কম ছিল। কিন্তু আজকে বেশি। গতবার দ্বিতীয় দিন ছিল এক লাখ ৬০ হাজারের মত। এবার এক লাখ ৮০ হাজারের মত। এখনো তো লোকজন ঢুকছে।”
এবার চিড়িয়াখানার অন্যতম আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে জেব্রা ও বাঘের শাবক। তিনটি জেব্রা শাবক ও ১১ মাস বয়সী বাঘের শাবক ‘শাপলা’ ও ‘পদ্মকে’ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
তবে গত বছর হাতির খেলা দেখানোর সময় এক কিশোর প্রাণ হারানোয় এবার কোনো পশুর খেলার আয়োজন করা হয়নি। এবার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে হাতির খেলাসহ সব খেলা বন্ধ রাখা হয়েছে।
ঈদের দিন ও দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো অঘটনের তথ্যও মেলেনি। মেলেনি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকির তথ্যও।
“নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হয়নি। আমার কাছেও কোনো অঘটন, অনিয়মের ওইরকম কোন তথ্য আসেনি,” বলছিলেন জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক।
তিনি বলছিলেন, নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের পক্ষে জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশের তৎপরতা রয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেই প্রত্যাশাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফে।
ঈদের ছুটিতে চিড়িয়াখানা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। ৫০ টাকার টিকেট কেটে দর্শনার্থীরা দিনভর উপভোগ করতে পারছেন। তবে নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটির অংশ হিসেবে রোববার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকবে।