ঢাকার ব্যবসায়ী সুমন হাসান; পদ্মা নদী পার হয়ে প্রায়ই শরিয়তপুরের জাজিরায় যেতে হত তাকে। এবার পদ্মা সেতু হয়ে যাত্রার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে বলেন, “একটি ফেরির জন্য কত দিন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি! কখনও যানজট তো কখনও কুয়াশা, কখনও ডুবোচর তো কখনও নাব্য সংকট। কখনও আবার স্রোত! নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল এই পথের ফেরি রুট। এখন পদ্মা সেতুর কারণে এ সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পেলাম।”
Published : 08 Jul 2022, 10:46 AM
পদ্মা সেতুর কারণে এমন অনেক বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ ঝরেছে সুমনের মত দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রীদের কণ্ঠে; তাদের চোখে ছিল স্বস্তির ছাপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে) দিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে টোল দিয়ে সেতু পার হয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে ছুটছেন যাত্রীরা। পদ্মা সেতু দিয়ে যাত্রা, তাদের ঈদ আনন্দ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। তাই বিড়ম্বনাহীন এই যাত্রায় উচ্ছ্বাসেরও শেষ নেই।
বৃহস্পতিবার শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে ফেরিতে ওঠা নামার সেই চিরচেনা প্রতিযোগিতা দেখা গেল না। চোখে পড়েনি গাদাগাদি করে পদ্মা পারাপারের দৃশ্যও। উত্তাল পদ্মায় লঞ্চ-স্পিডবোটে নদী পার হওয়ায় নেই বাড়তি ঝুঁকিও। সব মিলিয়ে ঈদে প্রিয়জনের মুখ দেখতে রাস্তায় দুর্বিসহ ভোগান্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার সেই চেনা দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে পদ্মা সেতু।
যেখানে ঈদ যাত্রায় পদ্মা পার হতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখো মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি ঘাটে অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে এখন ৬ থেকে ৭ মিনিটেই পদ্মা সেতু দিয়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন তারা।
বৃহস্পতিবার মাওয়া টোল প্লাজায় পদ্মা সেতু হয়ে বাসে যাতায়াতকারী একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। ঢাকার বাসিন্দা হারুন বলেন, তার শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুর; সকালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ফরিদপুর রেখে আবার ঢাকায় ফিরছেন। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ঈদের সময় ভোগান্তির কথা ভেবে বাসা থেকে বের হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারতেন না। এখন পদ্মা সেতুর কারণে সে ভোগান্তি আর নেই।
বাগেরহাটগামী মান্নান শেখ বলেন, “প্রায় ২৭ বছর ধরে আমি এই পথে যাতায়াত করছি। তবে এবারের ঈদ যাত্রার সাথে আগের কোনযাত্রাই মিলছে না। সারা রাস্তাই ছিল বিড়ম্বনাহীন। কিভাবে যে এখানে এসেছি; ভাবতেই অবাক লাগছে। একবারের জন্য কোথাও আটকে যাওয়ার দুশ্চিন্তা হয়নি। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!”
নৌবাহনে পার হতে হচ্ছে না। ফলে এখন ঝড় হল কি বৃষ্টি, কুয়াশা আছে বা নেই, নদীর ঢেউ বাড়লো না কমললো কিংবা ডুবো চর জাগলো কিনা-তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের। খরস্রোতা পদ্মা পার হওয়ার সময় বরং তার মুগ্ধতায় বিমোহিত হচ্ছেন তারা; এ যেন মহা প্রশান্তির এক অনুভূতি।
নদী পার হতে ফেরির অপেক্ষায় সড়কেই মৃত্যু হয়েছে রোগীর; সময় ফুরিয়েছে পরীক্ষার্থীর, প্রসূতির সন্তান প্রসব হয়েছে সড়কেই- এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী পদ্মার পাড়ের জেলাগুলোর বাসিন্দারা। পদ্মার দুই পাড়ের ফেরি ঘাট যেখানে শত বছরের ভোগান্তির সাক্ষী, সেখানে হবে বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র। মানুষ সেখানে ঘুরতে যাবে একটু প্রশান্তির আশায়।
ঈদ যাত্রায় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে টোলপ্লাজার সামনে নেই যানজট। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ঢাকা-মাওয়া অংশের টোল আদায় করা হচ্ছে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা থেকে।
মহাসড়কে প্রবেশে ৫টি ও বের হতে ৫টি বুথে মোট ১০টি বুথের মাধ্যমে অনেকটা নির্বিঘ্নে টোল আদায় কার্যক্রম চলছে। টোলপ্লাজায় আনসার সদস্যদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা থেকে টোলপ্লাজায় আগত মোটরসাইকেল ফিরিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
ঢাকা-মাদারীপুর পরিবহনের চালক রমিজ তালুকদার জানান, মহাসড়ক ও পদ্মা সেতুর টোল দিতে সময় লাগে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টোলের টাকা পরিশোধ করে গন্তব্যে রওনা দিতে পারছেন।
ধলেশ্বরী সেতুর কাছে এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজার ইনচার্জ নুর ইসলাম বলেন, “টোলে কোনো ভিড় নেই। গাড়ি পারাপার স্বাভাবিক রয়েছে। তারপরও যদি গাড়ির চাপ বাড়ে সেই প্রস্তুতিও আমরা নিয়ে রেখেছি। শুক্রবার থেকে টোল আদায় বুথ আরও দুটি বাড়ানো হচ্ছে। আশা করছি, ঈদে লোকজন কোনো ভোগান্তি ছাড়াই নির্বিঘ্নে মহাসড়ক পাড়ি দিতে পারবেন।”
বুড়িগঙ্গা নদীর পোস্তগোলা সেতু পেরিয়ে কেরানীগঞ্জে ঢুকলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কের শুরু। মহাসড়কটি দুই অংশে বিভক্ত। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার আর পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। তবে মহাসড়কের দুই পাশে সাইড সড়ক রয়েছে, যা দিয়ে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করতে পারে।
এই পথে ঈদের কারণে গাড়ির চাপ বাড়লেও নেই যানযট, নেই ভোগান্তি। চার লেনের সেতুর প্রশস্থতা তুলনামূলক বেশি থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে যান চলাচল করছে। ঈদকে সামনে রেখে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত সময় পার করছে দুই প্রান্তের টোল প্লাজা। বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যানসহ অনুমোদিত সব যানই পার হচ্ছে।
দ্রুত আসছে কোরবানির পশু, খুশি খামারিরা
যশোর থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রাকে করে কোরবানির জন্য গরু নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। সেতু উদ্বোধনের পর যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে এই গরু পরিবহনের কাজেই ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হতো ব্যবসায়ীদের।
“যশোর থেকে গরু নিয়ে ঢাকা যেতে হলে আগে দুই থেকে তিন দিন পার হয়ে যেত, কখনো কখনো গরু মারা যেত। এখন দ্রুত আসলাম। ভোগান্তি ছাড়াই এত দ্রুত পার হতে পারব ভাবিনি।” কথাগুলো বলছিলেন- যশোর থেকে গরু নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার দিকে যাওয়া গরু ব্যবসায়ী আক্কাস মিয়া।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে যশোর, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, বরগুনা, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা থেকে গরু নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যান ব্যবসায়ীরা। তাদের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, নরসিংহপুর চাঁদপুর ফেরি ঘাট পারাপার হতে হতো। যানজটের কারণে ঢাকায় ঢুকতে তাদের দুই থেকে তিন দিনও পার হয়ে যেত।
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে দেখা যায়, সেতুর টোল প্লাজায় কোনো যানজট নেই। গাড়ি আসলেই টোল দিয়ে সেতু পার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরুবাহী গাড়ির কোনো সিরিয়াল নেই।
শরীয়তপুরের গরু ব্যবসায়ী শফি মিয়া বলেন, “প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫টা গরু আমার নিজের পালে হয়। সেগুলো আমি ওখান থেকেই বিক্রি করে দিতাম। অনেক ঝামেলা হতো গরু নিয়ে ঢাকা বা অন্য কোথাও যেতে। কিন্তু এবার পদ্মা সেতু হওয়াতে গরু নিয়ে আমি নিজেই ঢাকায় যাচ্ছি। আশা রাখি ভালো ব্যবসা হবে।”
পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্টের টোল ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, “পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্টে যানজট নেই। গাড়ি নিরবচ্ছিন্নভাবে পার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই গরুর গাড়ি আসছে। টোল দিয়েই পার হয়ে যাচ্ছে।”