যে এলাকায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার খুন হয়েছেন, সেখানেই থাকেন তার বড় দুই ভাই, আছে তাদের দোকান। কিন্তু এখন সেখানে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
Published : 05 Jul 2022, 01:19 AM
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নিজেদের এলাকায় ভাইয়ের শেষকৃত্য সেরে অশৌচ পালনের মধ্যেই এখন কর্মস্থলে ফিরতে চাইছেন অসীম কুমার সরকার ও অসিত কুমার সরকার।
এক সপ্তাহ পর রোববার সাভারে এসেছেন তারা, কিন্তু আশুলিয়ায় যাননি। কেন- জানতে চাইলে অসীম বলেন, “আশুলিয়ায় যেতে ভয় লাগছে।”
উৎপল খুনের মামলাটির বাদী হলেন তার এই ভাই। মামলার আসামি স্কুলছাত্র আশরাফুল আহসান জিতুর পরিবার স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী বলেই অসীমের এই ভয়।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, পারিবারিক প্রভাবের কারণেই জিতু দল পাকিয়ে নানা ধরনের অপকর্ম করলেও পার পেয়ে যেত। র্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী, এই কিশোর ‘জিতু দাদা’ নামে একটি দল তৈরি করে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঘুরত, মোটর সাইকেল নিয়ে মহড়া দিত, মানুষকে হেনস্থা করত। তার বিরুদ্ধে বিচার দেওয়া হলে আরও ভয়-ভীতি দেখাত।
আশুলিয়ার চিত্রশাইলের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ে জিতু। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক ছিলেন উৎপল। তিনি কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন।
র্যাবের ভাষ্য, জিতুর এসব কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে উৎপল সরকার চেষ্টা করেছেন তাকে ‘কাউন্সেলিং’ করতে। আর তাতেই জিতু ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের শিক্ষক উৎপলকে গত ২৫ জুন ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পেটান, যাতে উৎপল মারা যান।
শিক্ষক খুনের এই ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ইতোমধ্যে র্যাব জিতুকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে এই কিশোরের বাবা উজ্জ্বল হোসেনও।
উৎপলের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। তারা পাঁচ ভাই। এর মধ্যে উৎপলসহ তিনজনেরই কর্মস্থল আশুলিয়ার চিত্রশাইলে। উৎপল পড়াতেন কলেজে, আর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই হাকিম মার্কেটে দীপ্ত টেইলার্স নামে একটি দর্জির দোকান চালান অন্য দুই ভাই।
চলনবিলের পল্লী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছনো উৎপলই এই পরিবারটিকে টেনে নিচ্ছিলেন। ২০১৩ সালে উৎপল ওই কলেজে চাকরি নেওয়ার পর ওই দোকানটি নেন। কাগজে-কলমে এর মালিক উৎপল হলেও এটি পরিচালনা করতেন তার মেজ ভাই অসীম ও সেজ ভাই অসিত।
তাদের অন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় অজয় কুমার সরকার এবং চতুর্থ আশুতোষ সরকার গাজীপুরে দুটি টেক্সটাইল মিলে চাকরি করেন। তাদের চাকরিও উৎপলের জোগাড় করে দেওয়া বলে জানান অসীম।
তিনি বলেন, “ভাইয়েরা বিভিন্নজন বিভিন্ন স্থানে থাকলেও আমাদের পরিবারটি একটা বৃহৎ যৌথ পরিবারের মতো। আট মাস আগে উৎপল ঢাকায় বাসায় নিলে আমরা অন্য দুজন চিত্রশাইলে থেকে যাই। প্রতিদিন কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ছোট ভাই (উৎপল) দোকানে আসত। তাই ও ঢাকায় বাসা নিলেও মনে হয়নি দূরে কোথাও চলে গেছে। ঘটনার দিন সকালেও ছোট ভাইকে কলেজে দেখেছি আমি। আর দুপুরের পর জানতে পারি তাকে মারধর করা হয়েছে।”
দোকানের আধা কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলা এলাকার একসঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন অসীম ও অসিত। আর তা আসামি জিতুর বাসার কাছে। তাই এখন বাসা বদল ফেলার চিন্তা করছেন অসীম।
তিনি বলেন, “মামলার পরিস্থিতি জানা, নিজেদের দোকান ও ভাড়া বাসার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আশুলিয়ায় যাওয়া দরকার। তাই গতকাল (রোববার) গ্রামের বাড়ি থেকে সাভারে এসে এক পরিচিতজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ছোট ভাই অসিতও আমার সাথেই আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দোকান আপাতত আগের জায়গাতে রাখলেও, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বাসাটা বদলে ফেলব।”
আশুলিয়ায় যেতে ভয়ের কারণ জানতে চাইলে অসীম বলেন, “শুনেছি জিতুর বাবা উজ্জল হাজি অনেক প্রভাবশালী, এলাকায় তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। জিতু আগে থেকেই এলাকার মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত, সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত ছিল।
“ভাইয়ের ভরসাতেই আমরা চিত্রশাইলে থাকতাম। ওরা আমার ভাইটাকে মেরে ফেলেছে। ওই এলাকাতে গিয়ে আমরা এখন কীভাবে ব্যবসা করব? কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে?”
কেউ কোনো হুমকি দিয়েছে কি না- জানতে চাইলে অসীম বলেন, “এখনও কেউ হুমকি দেয়নি বা ভয়ভীতি দেখায়নি, তবে কোনো অঘটন বা ঝামেলা তো হতেই পারে। আসামিরা জেলে থাকলেও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা তো আছে। আমরা তো ওখানে অস্থায়ী, আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে?”
এখন সাভারে থেকে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন অসীম। তিনি বলেন, “তারা আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বাস দিলে তবেই আশুলিয়াতে যাব। নয়ত সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না।”
উৎপলের ভাইদের উদ্বেগের বিষয়টি জানালে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা (উৎপলের পরিবার) এখনও পুলিশকে কিছু জানায়নি। তাদেরকে আশুলিয়া থানায় জানাতে বলেন। প্রয়োজনে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে দেন। পুলিশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যাবতীয় ব্যবস্থা নেবে।”
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কামাল তালুকদার]