‘শর্ট কাটে বেহেশতের লোভে’ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা: আদালত

উগ্রবাদী প্রচারে বেহেশত লাভের যে প্রলোভন দেখানো হয়, লেখক-অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তারই শিকার হয়েছিলেন বলে মনে করছে আদালত, যা তাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

মঞ্জুর আহমদ সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2022, 01:52 PM
Updated : 26 April 2022, 01:52 PM

মঙ্গলবার এই মামলার রায়ে প্রধান আসামি ফয়জুল হাসানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তার বন্ধু মো. সোহাগকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।    

সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব পর্যবেক্ষণে বলেন, জাফর ইকবাল শিক্ষকতার বাইরে দেশের একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞান বিষয়ে ও শিশুতোষ গ্রন্থ লিখে তিনি জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা পালন করে চলছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে তার অবস্থান সর্বজনবিদিত।   

প্রধান আসামি ফয়জুল সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, ফয়জুল ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী না বুঝে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যাকে পুণ্যের কাজ মনে করে এই বর্বর হামলা চালিয়েছেন। ইন্টারনেট সাইটে জিহাদি আর্টিকেল, জিহাদি বই পড়ে এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী বক্তার বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন।

ফয়জুল হাসানের সঙ্গে দেশ বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্লগার ও নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলায় ফয়জুল তাকে নিজ হাতে হত্যার পরিকল্পা করেন; ইসলামের শত্রু ও নাস্তিক আখ্যায়িত করে হত্যার চেষ্টা চালান।

অন্য আসামি সোহাগ মিয়া কাপড়ের ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ফয়জুলকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন জিহাদি বই, অডিও ও ভিডিও ক্লিপ সরবরাহ করে দেশের মুক্তমনা লেখকদের হত্যার ব্যাপারে শলাপরামর্শ করতেন বলেও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।

বিচারক বলেন, ফয়জুলের এহেন কাজ নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী কাজ, আরও স্পষ্ট করে বললে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’ ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু ভিন্নমত প্রকাশ এবং ভিন্নমত প্রকাশের জন্য এ দেশে হত্যকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ভিকটিমের উপর এহেন কার্য কোনোমতেই গহণযোগ্য নয়। কেননা স্বাধীন মতপ্রকাশ পরমতসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা তথা সভ্যতার অগ্রগতির নির্ণায়ক। এগুলোর চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পেছনের দিকে হাঁটবে। স্বাধীন ও গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব।  

অনলাইনে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা পর্যবেক্ষণে হয়, কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপে কৌশলে ভার্চুয়াল জগতে তাদের উগ্রবাদী সন্ত্রাসী মতবাদ ছড়িয়ে, সহজে বেহেস্ত যাওয়ার ‘শর্ট কাট’ রাস্তা দেখিয়ে তরুণ প্রাণে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে।

সাইবার জগতে এসব উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদানকারী বিভিন্ন সাইট বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে তাদের প্রচারিত তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোড়ালো ও কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ রা জরুরি বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে।

হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিচারক উল্লেখ করেন, হামলার নৃশংসতা এবং বীভৎসতা দ্বারা যেসকল লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে ভীতি, শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল আসামির মূল উদ্দেশ্য। এই আসামিকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা না দিলে অন্যান্য সন্ত্রাসী জঙ্গি উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজন এই ধরনের কাজে উৎসাহিত হবে।

২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায় মাদ্রাসা ছাত্র ফয়জুল হাসান।

এ ঘটনায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে ওইদিন রাতেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন।

মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক ও ভাই এনামুল হাসান।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আসামিপক্ষের আইনজীবী মোতাহির আলী বলেন, “রায়ে চার জন খালাস পেয়েছেন। এতে আমরা সন্তুষ্ট। দুজনকে দণ্ডিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আসামিদের সাথে আলাপ করে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”

মামলার বাদী শাহজলাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ইশফাকুল হোসেন বলেন, “রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পওয়ার পর আমরা আইনজীবীদের সাথে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”

আরও পড়ুন: