জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা: অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি

অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার মাদ্রাসা ছাত্র ফয়জুল হাসান ওরফে শফিকুর ‘জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী’ বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা ধারণা করলেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে খুব বেশি তথ্য তারা পাননি।

সিলেট প্রতিনিধিমঞ্জুর আহমেদ,  ও মাহমুদুর রহমান তারেক, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2018, 03:36 PM
Updated : 4 March 2018, 06:29 PM

জঙ্গি হয়ে থাকলে ফয়জুল কোন সংগঠনে জড়িত, তার সঙ্গে আর কারা জড়িত, একজন বহিরাগত হয়েও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের অনুষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গিয়ে কীভাবে তিনি ওই হামলা চালালো, সেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। 

শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে আহত ২৪ বছর বয়সী ফয়জুলকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর রোববার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সিলেটের জালালাবাদ থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে যে মামলা করা হয়েছে, সেখানে ফয়জুলসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।

ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুর রহমান, চাচা আব্দুল কাহেরসহ মোট ছয়জনকে এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ ও র‌্যাব।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, হামলাকারী যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ীই তারা ব্যবস্থা নেবেন।

হামলার পর ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় অধ্যাপক জাফর ইকবালকে

অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপর হামলার পর আটক ফয়জুল জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী বলে র‌্যাবের ধারণা

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শনিবার বিকালে ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফেস্টিভাল চলাকালে জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবালের ওপর যখন হামলা হয়, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানের কারণে অধ্যাপক জাফর ইকবালকে ২০১৬ সাল থেকেই সরকারের নির্দেশনায় পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছিল। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষক মাথা, পিঠ ও হাতে জখম নিয়ে এখন ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন।

তার ওপর হামলাকারী ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল কালিয়াকাপন এলাকায়। তার বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্ববর্তী টুকেরবাজারে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় তাদের বাসা।

ফয়জুলের পরিচয় জানার পর শনিবার রাতেই তাদের শেখপাড়ার বাসায় অভিযানে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু ওই বাসা তালাবন্ধ অবস্থায় পেয়ে পাশের আরেকটি বাসা থেকে তার মামা ফজলুর রহমানকে আটক করা হয়।

আর রোববার সকালে দিরাইয়ে ফয়জুলদের গ্রামের বাড়িতে অভিযানে যায় র‌্যাব। সেখানেও কাউকে না পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় ফয়জুলের চাচা আব্দুল কাহেরকে।

নগরীর বাসা ও বাড়িতে অভিযান চালিয়ে না পাওয়ার পর রোববার রাত ১১টার দিকে সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকা থেকে ফয়জুলের বাবা ও মাকে ধরা হয় বলে জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ফয়জুলের বাড়ি

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ফয়জুলের বাড়ি

সকালে কালিয়াকাপন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ফয়জুলদের গ্রামের বাড়ি তালাবন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাওলানা আতিকুলের তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে ফয়জুল দ্বিতীয়। ফয়জুলসহ দুই ছেলে সিলেটে থাকেন, আরেক ছেলে প্রবাসী।

ওই গ্রামের বাসিন্দা মকবুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য ভাইদের মত ফয়জুলও মাদ্রাসায় পড়ত। ২০০৮ সালে স্থানীয় ধল মাদ্রাসায় পড়ার সময় পরিবারের সঙ্গে সে গ্রাম ছাড়ে।”

আব্বাস মিয়া নামে আরেকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফয়জুল মাঝে মধ্যে গ্রামে এলেও কারো সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না। পড়াশোনার পাশাপাশি সে ফেরি করে গ্রামে কাপড় বিক্রিও করত।

ফয়জুলদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে তার ফুফু রেহেনা বেগমের বাড়ি।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সিলেটে যাওয়ার পর ফয়জুলরা খুব বেশি গ্রামে আসত না। তবে ফোনে আতিকুলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।

তবে ফয়জুল কীভাবে এসবে জড়ালো সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেননি তার ফুপু।

আব্দুস শীষ নামে ওই গ্রামের প্রবীণ এক ব্যক্তি জানান, ফয়জুরের বাবা ‘ভিন্ন পদ্ধতিতে’ নামাজ পড়তেন বলে গ্রামের মুসল্লির সঙ্গে তার কয়েকবার বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। এসব বিষয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে গ্রামের অনেকের সম্পর্ক খারাপ হলে তারা গ্রাম ছাড়ে।

ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক

অনুষ্ঠান মঞ্চে অধ্যাপক জাফর ইকবালের পেছনে দাঁড়ানো ফয়জুল

ফয়জুলকে আটক করার পর শনিবার রাতে তাকে সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে র‌্যাব। রাত দেড়টার দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জালালাবাদ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে শারিরিক অবস্থার উন্নতি হলে রোববার বিকালে ওই তরুণকে জালালাবাদ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমদ রোববার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, ফয়জুরের কাছে একটি ছুরি ও একটি চাবি তারা পেয়েছেন।

“সে বলেছে, দাখিল পাস করার পর আলিমে ভর্তি হয়ে সে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। তবে কোন মাদ্রাসায় সে লেখাপড়া করেছে, সে বিষয়ে একেক সময় একেক  কথা বলছে।”

জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুল র‌্যাবকে বলেছেন, জাফর ইকবাল ‘ইসলামের শত্রু’ বলে তাকে হত্যার জন্য হামলা চালিয়েছেন তিনি।

লেফটেনেন্ট কর্নেল আজাদ বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ফয়জুল জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। তবে তদন্ত ছাড়া এর বেশি এখনই বলা যাচ্ছে না।”

এ ঘটনায় ফয়জুলের চাচা ও মামা ছাড়া আর যে দুজনকে আটক করা হয়েছে, তাদের একজন হলেন সিলেট শহরের রাজা ম্যানশনের একটি কম্পিউটারের দোকানের মালিক। ফয়জুল এক সময় ওই দোকানে কাজ করলেও চলতি বছরের শুরুতে ছেড়ে দেন।

রোববার ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে একটি স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ওই কম্পিউটারের দোকানে সে (ফয়জুল) কাজ করত কিংবা আসা যাওয়া ছিল। সে এখনও অসুস্থ। আমরা তার থেকে যে তথ্য পাব, সে অনুযায়ী যা অ্যাকশন নেওয়া যায়- নেব।”

পুলিশি নিরাপত্তার পরও একজন বহিরাগত তরুণ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালাতে পারল- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “আমরা আরও তদন্ত করে নেই, তদন্ত করার আগে কিছু বলা উচিত না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, হামলার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন তারা।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল গণিকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শহিদুর রহমান।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন লিটন হায়দার]