সিনেমা হল বন্ধের ভিড়ে বগুড়ায় যাত্রা সিনেপ্লেক্সের

দর্শক খরায় একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার মধ্যে বগুড়ায় চালু হল ঢাকার বাইরে দেশের দ্বিতীয় সিনেপ্লেক্স; পুরনো ‘মধুবন হল’ থেকে রূপান্তরিত এ সিনেপ্লেক্সের প্রথম ছবি ভারতের ‘বাজি’।

জিয়া শাহীন বগুড়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2021, 06:34 PM
Updated : 16 Oct 2021, 05:39 AM

ডাকু মনসুর দিয়ে ১৯৭৪ সালে যাত্রা শুরু করা মধুবন সিনেমা হল নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে বন্ধ হয়ে যায় ২০১৮ সালে, শেষ প্রদর্শনী ছিল ঢাকা অ্যাটাক।

সেই বন্ধ চলচ্চিত্র পেক্ষাগৃহটিই আবার সরগরম হয়ে উঠল বিজয়া দশমীর দিন শুক্রবার।

চেলোপাড়ায় অবস্থিত শহরের পুরনো হলটির বাইরের চেহারা যেমন বদলেছে, তেমনি ধুলো ভরা সেই আসনগুলোও পেয়েছে নতুন সজ্জা।

নবরূপে পর্দা ভরে উঠেছে রঙিন আলোয়, নতুন সাউন্ড সিস্টেমে গমগম করে উঠেছে হলের ভেতরটা। বড় পর্দার সিনেমার ভুবনে দর্শকের সাড়াও মিলেছে বেশ।

স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টার মুভিজের পর এটি দেশের তৃতীয় সিনেপ্লেক্স। ঢাকার বাই‌রেও আ‌রো ক‌য়েক‌টি শাখা খোলার প‌রিকল্পনার কথা ব‌লে‌ছে।

একের পর এক হল বন্ধের ভিড়ে সিনেপ্লেক্সের মাধ্যমে বড় পর্দার যাত্রাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন অনেকে। 

সিনেমা হল মা‌লিকদের সংগঠন বাংলা‌দেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক স‌মি‌তি জা‌নি‌য়ে‌ছে, ১৯৯৮ সালে দে‌শে এক হাজার ২৩৫‌টি সি‌নেমা হল ছিল। দুই যু‌গের ব্যবধা‌নে হ‌লের সংখ্যা কম‌তে কম‌তে এখন ১২০টি‌তে নেমে‌ছে। 

ক‌রোনাভাইরাস প‌রিস্থি‌তি‌তে যেগুলোর ম‌ধ্যে বেশিরভাগ বন্ধ র‌য়ে‌ছে। 

অপরদিকে সব‌শেষ পাঁচ বছ‌রে রাজধানীর কাকরাই‌লের রাজমণি, পূ‌র্ণিমাসহ ঢাকার নামকরা ক‌য়েক‌টি হল বন্ধ হয়ে‌ছে। অ‌ভিসার, নেপচুনসহ আরও ক‌য়েক‌টি হল ব‌ন্ধের প্রক্রিয়া চল‌ছে ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছে মালিকপক্ষ। 

প্রদর্শক স‌মি‌তির উপ‌দেষ্ট সুদীপ্ত কুমার দাস বি‌ডি‌নিউজ টো‌য়ে‌ন্টি‌ফোর ডটককম‌কে জানান, অশ্লীল সিনেমার প্রকোপে হল থে‌কে দর্শক‌দের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ভা‌লো সি‌নেমা নির্মাণ না হওয়া, সিনেমার পাই‌রে‌সির কার‌ণে ব্যবসায় মন্দার কার‌ণে ‌একের পর এক হল বন্ধ হ‌য়ে‌ছে। 

ব‌ন্ধের ভি‌ড়ে মধুবন সি‌নে‌প্লেক্স চালু করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জা‌নি‌য়ে‌ছেন সুদীপ্ত। 

সি‌নেমা হ‌লে দর্শক ফেরা‌তে দে‌শে ভা‌লো ছ‌বি নির্মা‌ণের পাশাপা‌শি ভারতীয় ছ‌বি আমদানির সরকা‌রি অনুম‌তি চাই‌ছেন তি‌নি। 

মধুব‌নের যাত্রা শুরুর দি‌নে হল মা‌লিক‌ স‌মি‌তির সহসভাপ‌তি মিয়া আলাউদ্দিন ব‌লেন, "এ‌কের পর সিনেমা হল যখন বন্ধ হ‌চ্ছে তখন ঝুঁ‌কি নি‌য়ে মধুবন চালু হ‌য়েছে। প্রথম‌দিন থে‌কে দর্শক‌দের কাছ থেকে ভা‌লো সাড়া পা‌চ্ছেন ব‌লে মা‌লিক জানা‌লেন।"

কেমন ছিল মধুবনের প্রথম দিন

নতুন করে শুরুর প্রথম দিন বিকাল তিনটায় দেখানো হয় প্রথম প্রদর্শনী। এর আগেই লাইন ধরে টিকেট কাটতে দেখা যায় অনেককেই।

সিনেপ্লেক্সের ফুড কর্নার, ভেতরে ও সামনে ব্যস্ততা ছিল কর্মীদেরও। পোস্টার, ব্যানার লাগানো হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে, হলের উপরে। পথচারীরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখছেন। কেউ কেউ হলের সামনে ঘুরে যাচ্ছেন। ভেতরে ঢু মারতে দেখা গেছে অনেককে।

মেয়েকে নিয়ে ছবি দেখতে এসেছিলেন সূত্রাপুর এলাকার সাবিনা। জানালেন, ৩০ বছর পর বড় পর্দায় ছবি দেখলেন তিনি।

“খুবই ভালো লেগেছে ছবি এবং হলের পরিবেশ,“ বলেন তিনি।

জ্বালেশ্বরী তলার কলেজ পড়ুয়া অমিত জানান, হলে সিনেমা দেখা এটাই তার প্রথম। তাই ভালো লাগাটা অন্যরকম বলে জানালেন তিনি।

নিউ মার্কেট এলাকার হাসান উদ্দিন স্বপরিবারে সিনেমা দেখতে এসেছিলেন।

হলের নতুন পরিবেশে মুগ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, “বগুড়া শহর ও উপজেলায় আর কোনো হল নেই। বড় পর্দায় ছবি দেখে খুশী লাগছে। স্বপরিবারে দেখার মত ছবি হলে সিনেমা হলে ভিড় জমবে।“

দর্শক ফিরবে বড় পর্দায়, আশা মালিকের

আবার নতুনরূপে সিনেপ্লেক্স হিসেবে হল চালু করতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এর কর্ণধার আর এম ইউনুস রুবেল।

তিনি বলেন, “সিনেমা হল না থাকলে থাকবে না ‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। হল থাকলেই পরীমনি, অপু, শাবনুর, জয়া, শাকিব হবেন স্টার। তা না হলে সবই শূন্য।

“ভালো ছবি নির্মাণ না হলে নতুন হলও থাকবে না। কারণ দর্শকরা মুখ ফিরে নেবেন। যতই বলা হোক মোবাইল ফোনই এখন সিনেমা হল, তবুও দর্শকদের কাছে সিনেমা দেখার মূল আনন্দ সিনেমা হল।“

ভালো ছবি না থাকায় দেশের দেড় হাজার হলের মধ্যে এখন মাত্র দেড়শ টিকে আছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি জানান, কোভিড মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দশমীর দিন বিকাল তিনটা থেকে প্রদর্শনী চালু করা হয়েছে। প্রথম দিনে ভালোই দর্শক সাড়া পেয়েছেন।

৩৪০ আসন নিয়ে নতুন আঙ্গিকে হল চালু করতে পাঁচ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান তিনি।

রুবেল জানান, সিনেপ্লেক্সরে জন্য বেলজিয়াম থেকে মেশিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাউন্ড সিস্টেম, বোম্বে থেকে গ্যালালাইট মেটাল কোটেড পর্দা আনা হয়েছে। হলের নিচে বিশাল পরিসরে রয়েছে আধুনিক ফুড কর্নার।

তিনি জানান, তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত বৃটিশ সেনা অফিসার লেফেটেনেন্ট এ এম ইউনুস ১৯৬৯ সালে হল নির্মাণ শুরু করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে কাজ থেমে যায়। এক হাজার আসনের হলটি ১৯৭৪ সালের ১০ অক্টোবর ঈদের দিন ডাকু মুনসুর ছবির মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু করে।

শহরের প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, এ হলকে কেন্দ্র করেই বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার উন্নয়ন যেমন ঘটেছে তেমনি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ভূমিক রয়েছে হলটির। মহল্লাটিও জমজমাট হয়ে উঠে এরপর থেকেই।

মধুবন সিনেপ্লেক্স চালুর পর নতুন করে আবারও ওই এলাকায় চাঞ্চ্যল্য বাড়বে বলে মনে করছে এলাকাবাসী।

বর্তমান মালিক রুবেল জানান, দীর্ঘদিন ভালোভাবে চললেও ৯০ দশকে অশ্লীল ছবির কারণে তারা হল বন্ধ করে দেন। ২০০৪ সালে স্টাফরা নিজেরাই হলটি আবার চালু করে। মাঝে বন্ধ থাকার পর আবার ২০১৩ - ২০১৪ সালের দিকে চালু করা হয়। পরে লোকসান বাড়তে থাকায় ২০১৮ সালে এটি বন্ধ করা হয়। শেষ প্রদর্শনী ছিল ‘ঢাকা অ্যাটাক’।

পরে এটিকে মধুবন সিনেপ্লেক্স করার চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করেন বলে তিনি জানান।

করোনাভাইরাসের কারণে বিঘ্নিত না হলে আরও আগেই এটি চালু হতো বলে তিনি যোগ করেন।