শতবর্ষের খাদি পণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে হাল-ফ্যাশনের প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে।
Published : 07 Apr 2024, 09:14 AM
রোজার ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে, কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি পোশাক ও কাপড়ের বাজার ততই জমে ওঠছে।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, খাদির বিভিন্ন পোশাক থাকলেও পুরুষদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে পাঞ্জাবি আর ফতুয়া। আর মেয়েদের কাছে খাদির থ্রি-পিসের চাহিদা ব্যাপক।
ঈদকে কেন্দ্র করে নগরীর প্রতিটি খাদি দোকানেই ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজগঞ্জ বাজারের পশ্চিম দিক থেকে কান্দিরপাড়ের রামঘাটলা পর্যন্ত দোকানগুলোতে ঘুরে ক্রেতাদের বেশ উপস্থিতি দেখা গেছে।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য ডাক ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই সময় থেকেই কুমিল্লা নামের সঙ্গে খাদি কাপড়ের নামটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। খাদি কাপড়কে বলা হয়ে থাকে কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক।
তবে যাত্রা শুরুর সময়ের সেই মোটা খাদি কাপড় এখন অনেকটাই মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। খাদি কাপড় কুমিল্লাকে ব্র্যান্ডিং করে। ক্রেতাদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে।
কুমিল্লার খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, শতবর্ষের ঐতিহ্য, সুনাম ও খ্যাতি অক্ষুন্ন রাখার লড়াইয়ে এখনো টিকে রয়েছে কুমিল্লার খাদি। কালের পরিক্রমায় খাদি পরিণত হয়েছে বাঙালির অন্যতম ফ্যাশন প্রিয়তায়। শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। শতবর্ষের খাদি পণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে হাল-ফ্যাশনের প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে।
খাদি কাপড় বিক্রেতাদের ভাষ্য, দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে খাদি পোশাকের কদর বেশি। পুরুষরা কিনছেন, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। আর নারীদের প্রিয় থ্রি-পিস। সেই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে খাদি কাপড়ের তৈরি বিছানার চাদর ও নকশিকাঁথা। প্রতি বছরের রোজার ঈদের মতো এবারও ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে নানা ধরনের নকশায় তৈরি করা হয়েছে খাদি পোশাক।
নগরীর মনোহরপুর এলাকার ‘খাদি ভবন’ দোকানের ব্যবস্থাপক বাবুল পাল বলেন, “দেশ-বিদেশে এখনো খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ বছর রমজানের শুরুর দিক থেকেই বেচাকেনা ভালো। মানে ভালো দামে কম হওয়ায় মানুষ খাদি পোশাক কিনছেন। ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে পাঞ্জাবি আর থ্রি-পিস। প্রতিনিয়ত ঐতিহ্য রক্ষা করে খাদি কাপড়ে নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগছে; এজন্য ক্রেতারা খাদি কাপড় বেশি কিনছেন।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় খাদির নাম যুক্ত দোকান আছে চার শতাধিক। এর মধ্যে কুমিল্লা নগরীতেই রয়েছে তিন শতাধিক। নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের পশ্চিম দিক থেকে কান্দিরপাড়ের রামঘাটলা পর্যন্ত এসব দোকানের অবস্থান।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদি শিল্পে সংকট দেখা দেয়। পরবর্তীতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান।
খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’। জেলা সদর ছাড়াও চান্দিনা, দেবিদ্বার উপজেলায় এখনো ঐতিহ্যগতভাবে খাদি কাপড় তৈরি হয়। হাতের পাশাপাশি মেশিনেই বর্তমানে বেশি খাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে। এজন্য মোটা খাদি কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। বর্তমান খাদির পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া, চাদর ও থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে পুরো দেশেই। কুমিল্লার ঐতিহ্যের খাদি কাপড় যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও।
তবে প্রতিষ্ঠার শত বছর পার হলেও খাদি এখনো জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন কুমিল্লার শিক্ষাবিদ ও কবি নজরুল গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক।
তিনি বলেন, “কুমিল্লার খাদি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক। জিআই পণ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এবং কুমিল্লার জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হতে হবে। কারণ খাদি কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক।”
কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার লাকসাম রোডের খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক রতন পাল বলেন, রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার খাদি কাপড় বেশি বিক্রি হয়। শুধু রমজানের ঈদেই কুমিল্লায় প্রায় শত কোটি টাকার খাদি কাপড় বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীদের পুরো বছরের ঘাটতি পুষে যায় রোজার ঈদে।
একই দোকানের আরেক মালিক তপন পাল বলেন, “সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাদি কাপড় কিনতে আসছেন মানুষজন। আশা করছি, এবারের ঈদে ভালোই লাভ হবে খাদি ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে খাদির পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। তবে খাদির ঐতিহ্যবাহী শাড়ি এবং থ্রি-পিসও বিক্রি হচ্ছে ভালো।”
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নগরীর মনোহরপুর এলাকার ‘খাদিঘর’ নামক দোকানের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও মজুরি খরচ বাড়ায় বর্তমানে খাদি কাপড়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে এটা ঠিক যে, দামে ও গুণমানে কুমিল্লার খাদির চেয়ে কম মূল্যে কোনো ব্র্যান্ডের কাপড় এখনো পাওয়া যায় না।
“হাতে তৈরি কাপড় হওয়ায় খাদির পোশাক পরে একটা ন্যাচরাল ফিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসে খাদিসহ দেশীয় পণ্যের প্রদর্শনী করা যেতে পারলে এ পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে। এখনো দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে কুমিল্লার খাদি পোশাকের।”
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে কুমিলা নগরীর কান্দিরপাড়, মনোহরপুর ও রাজগঞ্জ এলাকার দোকানগুলোতে খাদির বিভিন্ন পোশাক বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ বছর খাদি পোশাকগুলোর মধ্যে সাদা ও রঙিন পাঞ্জাবি সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, মেয়েদের থ্রি পিস ৫০০ থেকে চার হাজার টাকা, শর্ট ফতুয়া ৩০০ থেকে ২৫০০ টাকা, শাড়ি ৫০০ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকা, শার্ট ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দামে মিলছে।
এ ছাড়া বিছানার চাদর ৪০০ থেকে ছয় হাজার টাকা এবং নকশিকাঁথা তিন থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর মনোহরপুর এলাকার একটি দোকানে খাদি কাপড় কিনতে আসা শাহনাজ আক্তার পারভীন বলেন, “খাদির থ্রি-পিস আমার পছন্দের। বাসার অন্যরাও খাদির জামা পরতে পছন্দ করে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো বাজেটের মধ্যে ভালোমানের খাদি পোশাক পাওয়া যায়। তাই রোজার ঈদের জন্য খাদি জামা কিনতে এসেছি।”
জেলার মুরাদনগর থেকে আসা ক্রেতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “প্রতি বছরই ঈদে খাদির পাঞ্জাবি পরি। ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে খাদির ভালোমানের পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। এ ছাড়া খাদির পাঞ্জাবি পরতেও আরাম লাগে। তাই তরুণরা ঈদে খাদির পাঞ্জাবি বেশি কিনছেন।”
একই কথা বলেছেন জেলার মনোহরগঞ্জ থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, “দামে কিছুটা কম এবং মানে ভালো হওয়ায় খাদি কাপড়ের চাহিদা সব সময়ই ভালো। এ ছাড়া খাদি কাপড় প্রতিনিয়ত আধুনিক ডিজাইনের হওয়ায় মানুষের নজর কাড়ছে।”
কুমিল্লার সামাজিক সংগঠন তিন নদী পরিষদের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক আবুল হাসনাত বাবুল বলেন, খাদি কাপড়ের বুননে বৈচিত্র্য আসায় নারী-পুরুষ সবার কাছে যুগের পর যুগ ধরে এর জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রয়েছে। ঈদ, নববর্ষ ও পূজা উপলক্ষে খাদির পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রি-পিস ও শাড়ির বেশ চাহিদা সব সময়ই থাকে।
এক সময় খাদি কাপড় অনেক ভারি ছিল উল্লেখ করে আবুল হাসনাত বাবুল বলেন, তবে এখন ওই কাপড় প্রতিনিয়ত মিহি করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এখন খাদি নিয়ে ভাবছে। এদের হাত ধরেই খাদি কাপড়, খাদি পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার নকশায় বৈচিত্র্য আসছে। আমার বিশ্বাস তরুণ প্রজন্ম কুমিল্লার খাদিকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।