কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এবার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। এই পোকা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
Published : 06 May 2023, 12:30 PM
রংপুরে ইরি-বোরো ধানে দেখা দিয়েছে পাতা মোড়ানো মাজরা পোকা। পোকার আক্রমণে দিনদিন ধান গাছের পাতা হলুদ বর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে গোড়া পচা রোগ দেখা দেওয়ায় ধানের ফলন নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা। কিন্তু ফসল রক্ষার কোনো উপায় না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তারা।
চাষিরা বলছেন, পোকার হাত থেকে ফসল রক্ষায় বাজারে পাওয়া কীটনাশক জমিতে ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাদের আশঙ্কা, সময়মতো পোকা দমন করতে না পারলে এবার ইরি-বোরো উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বৃহস্পতিবার-শুক্রবার সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য। তারা কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও করেন।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে- তাদের কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। এবার ফলন ভালো হয়েছে, পোকার আক্রমণে তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।
সদর উপজেলার চিলমন পাঙ্গাটারী এলাকার কৃষক মজিবর রহমান টসা (৫৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমককে বলেন, আর কয়েকদিন পরেই গাছের ধান কাটা শুরু করার কথা, কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়েছে পোকার আক্রমণ।
“ধানগাছ প্রথমে হলুদ ও পরে শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করছে। কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফসলের মাঠজুড়ে এখন শুধু পোকা আর পোকা।”
পাগলাপীর এলাকার কৃষক রহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ধান পাকতে না পাকতে এমনভাবে পোকার আক্রমণ করছে, রাতারাতি ধান খেয়ে ফেলছে। আর সেই সাথে পচানি রোগ লেগেই আছে।
“আমার প্রায় চার বিঘা জমিতে পোকা আক্রমণ করেছে। কীটনাশক স্প্রে করেও এই পোকা দমন করা যাচ্ছে না। এ যাবত চারবার কীটনাশক স্প্রে করেছি। প্রতিবার স্প্রে করতে বিঘা প্রতি প্রায় সাত-আটশ টাকা করে খরচ হচ্ছে। তারপরও কোনো কাজ হচ্ছে না। “
সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চিলমন ছালাকপাকটারী এলাকার বাদশা মিয়া (৪০) বলেন, “মরার উপর খাড়ার ঘা, এক দিকে পোকা, অন্যদিকে গোড়া পচানী, আমরা কৃষকরা যাব কোন দিকে। সপ্তাহে দুইবার করে স্প্রে করেও কোন লাভ হয় না।”
তিনি অভিযোগ করেন, “কোন দিন দেখলাম না যে আমাদের এখানে সরকারি কোনো কৃষি কর্মকর্তা আসলো জমি দেখতে।”
পীরগঞ্জ উপজেলার ৩ নম্বর বড়দারড়া ইউনিয়নের শাহ পাড়া হাজিপুর গ্রামের মহেশ চর্ন্দ্র বর্মন (৭২) বলেন- “বাবা, আমি দশ একর জমিতে আমন ধান লাগিয়েছি, কিন্তু যে হারে পোকার আক্রমণে বিভিন্ন রোগ ধরছে তাতে মনে হয় না- আমরা ভাল মতে ধান ঘরে তুলতে পারবো।”
আর কৃষি অফিসারে সাথে যোগাযোগ করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারাতো বলেন- কীটনাশক স্প্রে করেন, ঠিক হয়ে যাবে।”
পীরগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর সদর ইউনিয়নের ওসমানপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম (৬০) এর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “হামরা বাহে অশিক্ষিত মুরখো মানুষ, এবার হামরা ৩ একর জমিত আমন ধান লাগাইছি। হামার ধানের অবস্থা ভাল না, পোকার জালায় ধান বাচপার পাবান্ন নই। কোনো ওষুধ দিয়ে কাম হয়ছে না। তোমাক কয়া হাবার কি হইবে।”
একইভাবে বলেন, মিঠাপুকুর উপজেলা ১৪ নম্বর সদর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের ভবেশ চর্ন্দ্র (৫২), মহব্বত খা, মাহফুজার রহমান, সাহেব গঞ্জ এলাকার রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই।
জমিতে পোকার আক্রমণের কথা জানিয়ে তারা বলেন, সুদে ঋণ নিয়ে এবার আমন ধান চাষ করেছেন অনেকে। কিন্তু ধান বের হতে না হতেই পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এই পোকা ধান গাছের পাতা খেয়ে বিবর্ণ করে ফেলছে।আবার ধানের গাছের মাঝ খানে কেটে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে রংপুর মেট্রাপলিটন কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার গাজীউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোগ তো হবেই। আমরাতো কাজ করছি। সব কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তো আর খবর নেওয়া সম্ভব না, ভাই। যারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি।”
রংপুর মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্প্রতি সময়ে ধানের ক্ষেতের পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ, ধানের গোড়া পচন রোগ দেখা দিয়েছে, এগুলো ধানের ছত্রাকজনিত রোগ। কৃষকরা ধান ক্ষেতে কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার করলে পোকার আক্রমণ কমে যাবে।”
পোকা দমনে কৃষকদের অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, বলেও জানান তিনি।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৪ টন। গত বছর ছিল ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৭৭৫ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা জানান, এবার গত বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৫ হাজার ৪০৯ টন ধান বেশি হবে। এবার প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৩২ টন ধান উৎপাদন হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বছর প্রকৃতি এখনো অনুকূলে রয়েছে। প্রতিনিয়ত কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষকেরাও প্রতিনিয়ত দক্ষতা অর্জন করেছেন।
“এসব নানা কারণে চলতি মৌসুমে অন্য জেলার চাইতে রংপুরে বোরো ধানের ফলন অসম্ভব ভালো হয়েছে। এবার ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরকেও ছাড়িয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে বিআর-২৮, বিআর-২৯, বিআর-৮১, বিআর-৮৮, বিআর-৮৯ জাতের ধান ছাড়াও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ হয়েছে। “জেলায় চালের চাহিদা আছে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন হবে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন চাল অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে।”
কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ধানক্ষেতে পোকার আক্রমণ নিয়ে তিনি বলেন, “ধানগাছের হলুদ বর্ণ রোধে ও পোকার আক্রমণ থেকে ধানগাছ রক্ষায় কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও পোকা দমনে ধান ক্ষেতে পার্চিং পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মাঠ পর্যায়ে আমাদের অফিসারগণ দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। ইনশাল্লাহ, এই পোকা আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”