প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে বাকি আর ৯ মাস, কিন্তু আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়কের কাজ শেষ হয়েছে কেবল অর্ধেক। এ অবস্থায় চালক ও যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
Published : 18 Sep 2024, 01:40 AM
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতীয় ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা চলে যাওয়ায় আশুগঞ্জ-আখাউড়া জাতীয় মহাসড়ক চার লেইনে সম্প্রসারণ এবং আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে বাকি আর ৯ মাস, কিন্তু আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়কের কাজ শেষ হয়েছে কেবল অর্ধেক। এদিকে প্রকল্পের কাজের কারণে এ সড়কে চলাচলকারী পরিবহন চালক ও যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
অন্যদিকে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের কাজ শেষে উদ্বোধন হলেও কাস্টমস, প্ল্যাটফর্ম ও সংযোগ সড়কের কাজ বাকি থাকায় সেটিও চালু করা যায়নি।
কবে নাগাদ এ দুটি প্রকল্পের কাজ আবার শুরু হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা বলতে পারছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প বিলম্বিত হলে ব্যয় বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকছে।
‘হাই কমিশন সবুজ সংকেত দিলে তারা আসবেন’
প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ বাড়াতে এ দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারত। দুই প্রকল্পে নিয়োজিত ছিল ভারতীয় ঠিকাদারি কোম্পানির প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কটি চার লেইনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ, কোভিড মহামারী ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বিলম্বিত হয় প্রকল্পের কাজ।
প্রায় ৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে পাঁচ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা; যা বাস্তবায়ন হচ্ছে ভারতের ঋণ সহায়তা ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে।
তিনটি প্যাকেজের মাধ্যমে এ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রথমটি আশুগঞ্জ থেকে সরাইল, দ্বিতীয়টি সরাইল থেকে আখাউড়ার তন্তরবাজার এবং তৃতীয় প্যাকেজটি তন্তরবাজার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত। সবকটির কাজই করছে ভারতীয় ঠিকাদারি কোম্পানি এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে।
এর মধ্যে তৃতীয় প্যাকেজের কাজ এখনও শুরুই করতে পারেনি ঠিকাদার। তিন দফায় বাড়ানো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়ক প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. শামীম আহমেদ বলেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে ঠিকাদার কোম্পানির প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতে চলে যান। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে নির্মাণ সামগ্রী ও দামী যন্ত্রাংশ।
“ভারতীয় হাই কমিশন থেকে নিরাপত্তার কথা বলে ঠিকাদার কোম্পানিকে পুনরায় বাংলাদেশে এসে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, হাই কমিশন থেকে সবুজ সংকেত পেলে তারা বাংলাদেশে আসবেন এবং কাজ শুরু করবেন। তবে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনও বলা যাচ্ছে না।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রকল্পের কাজ যেহেতু পরিকল্পিতভাবে চলছিল, যেহেতু এই মুহূর্তে কাজ বন্ধ রয়েছে এবং সামনে আরও কতদিন বন্ধ থাকবে তা বলা যাচ্ছে না, সেহেতু বলা যায়, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়নো হতে পারে।
“সেক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তেও পারে। সুনির্দিষ্ট করে এখনই কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না। এর ফলে কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে সেটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।”
দুর্ভোগের শেষ কবে?
আশুগঞ্জ থেকে ধরখার পর্যন্ত নির্মাণাধীন মহসড়কের বিভিন্ন অংশে ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে বড় বড় খানাখন্দের কারণে যানচলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বরোড মোড়ে প্রায় প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে।
শহরের ফুলবাড়িয়া থেকে পুনিয়াউট পর্যন্ত ওভারপাসটির পিলারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নিচে মহাসড়কে খানাখন্দের কারণে এই সড়ক ব্যবহার না করে শহরের ভেতর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করছে। ফলে জনদুর্ভোগ নিত্যদিনের।
ফুলবাড়িয়া গ্রামের আবদুর রহমান বলেন, “২০১৭ সাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। নানা কারণে কাজ শুরু করতেই তারা দেরি করেছে। এখন ২০২৪ সাল। আবার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ধারণা ছিল, আগামী জুনেই কাজ শেষ হবে। কিন্ত কখন যে আমাদের দুর্ভোগ শেষ হবে তা কেউ বলতে পারছে না।”
এ ব্যাপারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তিনি।
ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ৭৬ কিলোমিটার পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দুটি মহাসড়কেরই চার লেইন প্রকল্পের কাজ চলমান।
আশুগঞ্জ থেকে তন্তর বাজার পর্যন্ত মহাসড়কের কাজ বন্ধ থাকায় এখন করুণ দশা; খানাখন্দের কারণে যানবাহন চলছে বেশ ঝুঁকি নিয়ে। প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে মহাসড়কে। তাতে একদিকে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে, তেমনি চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের।
কুমিল্লা থেকে সিলেটগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের চালক আওয়াল মিয়ার সঙ্গে কথা হয় কাউতলী মোড়ে। তিনি বলেন, তন্তর বাজার থেকে কাউতলী মোড় পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টা। খানাখন্দের কারণে এবং নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় সড়ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।
এমন অবস্থা থেকে মুক্তি চান ওই বাসের যাত্রী বিলকিছ আক্তারও। চালকের পাশের সিটে বসা বিলকিস চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, দ্রুত সড়কের কাজ শেষ করতে আপনারা সরকারকে লিখুন।
একই অবস্থা আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত। সিলেটগামী প্রতিটি যাত্রীবাহী বাসকে বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকতে হচ্ছে।
উদ্বোধন হলেও ট্রেন চলে না
উদ্বোধন হলেও আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। কাজ বাকি থাকায় এখন প্রায় ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এই প্রকল্প নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ভারতের আগরতলার নিশ্চিন্তপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলসংযোগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে রেলপথে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে।
উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রকল্পের ভারতীয় ঠিকাদার কোম্পানি টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপকসহ সাত প্রকৌশলী ৫ অগাস্ট দেশে চলে গেছেন। ফলে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পটির অবশিষ্ট কাজ।
রেলপথ পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ায় কয়েক দফায় ট্রায়াল রান শেষে গত বছরের ১ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ লাইনের উদ্বোধন করেন। তবে তখনও কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ভবন, প্ল্যাটফর্ম এবং সংযোগ সড়কের কাজ বাকি ছিল। ১০ মাসেও সেই কাজ শেষ হয়নি।
কবে নাগাদ প্রকল্পে নিয়োজিতরা কাজে ফিরবেন সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে।
আখাউড়ার ইউএনও গাজালা পারভীন রুহি বলেন, “এই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং টেকনিক্যাল লোকজন এই মুহূর্তে প্রকল্প এলাকায় নেই। তারা ৫ অগাস্টের পর থেকেই নেই।”
ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে কথা বলার জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হবে বলে জানান তিনি। বলেন, “এটা তো আসলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিষয়। এখানে আপনাদের জানানোর মত আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।”
২০১৮ সালের জুলাইয়ে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পুরো রেলপথটির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশ পড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার।