অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধে গত নভেম্বরে ৮ দিন অভিযান চালিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
Published : 29 Dec 2024, 11:33 AM
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় ঝুঁকিতে পড়েছে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ডান তীর রক্ষা বাঁধ।
জরিমানা-কারাদণ্ড দিয়েও ওই এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে বালু উত্তোলনের এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন নড়িয়া উপজেলা বিএনপির নেতা আজাহার শিকারি।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তারেক হাসান বলেন, নদী থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে যে পরিমাণ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে প্রতিনিয়ত ডান তীর রক্ষা বাঁধ নিয়ে ঝুঁকি বাড়ছে।
নড়িয়া পাঁচগাও গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ হাতেম আলি বলেন, “এ পর্যন্ত তিনবার নদী ভাঙনে সব হারিয়েছি।এখন বাঁধের পাশে ঘর তুলে বসবাস করছি।
“অনেক কষ্টে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি। সরকার বাঁধ দিয়েছে, তাই আশা নিয়ে ছেলের টাকায় এক টুকরা জমিও কিনেছি। এখন আবার বাঁধ ভাঙলে কোথায় যাব?”
সুরেশ্বর এলাকার লস্কর বাড়ির বাগানে ঘর তুলে থাকা সেতাব আলী ঢালি বলেন, নদী সব কেড়ে নিয়েছে। এখন লস্কর বাড়ির বাগানে থাকি। বাঁধ ভেঙ্গে গেলে সে আশ্রয়টুকুও থাকবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জেলার নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর, কেদারপুর, ঘরিসার ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন ছিল। এতে ওই সময়ে অন্তত ২৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে।
পরে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাজিরা উপজেলার সফি কাজীর মোড় থেকে নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর এলাকা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
এ ছাড়া পদ্মা নদীর ডান তীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে ১২ কিলোমিটার নদীর চর খনন করা হয়। এসব প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
কিন্তু এখন অনিয়ন্ত্রিত অবৈধ বালু উত্তোলনে ফের ভাঙনের শঙ্কা জাগছে স্থানীয় দের মনে।
বালু ক্রেতা, বালু তোলার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর মুলফৎগঞ্জ, চরজুজিরা, কেদারপুর ও সুরেশ্বর এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে বালু উত্তোলন শুরু করে এ চক্রটি। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি কাটিং ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা চলে ভোররাত পর্যন্ত।
প্রতি রাতে তোলা হয় ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ ঘনফুট বালু। এরপর এই বালু বাল্কহেডে করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বালু তোলার কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিক বলেন, রাতে বালু উত্তোলনের পর দিনের বেলা ড্রেজারগুলো নদীর তীরে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়।
একেকটি ড্রেজার দিয়ে প্রতি রাতে ২ লাখ থেকে ৩ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয়।
প্রতিটি বাল্কহেডে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনফুট বালু বোঝাই করা হয়। মান ভেদে প্রতি ঘনফুট বালু বিক্রি হয় ৫ থেকে ১০ টাকায়।
কয়েক বছর ধরে ড্রেজার দিয়ে একটি চক্র অবৈধভাবে এই বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে। তবে অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বর থেকে বালু তোলার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আজাহার ইসলাম শিকারি, নুরুজ্জামাল শেখ, দিনু খান, তারা মিয়া, রাজীব মুন্সি, সুমন খান।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা আজাহার শিকারি বলেন, “নদীভাঙনে আমাদের অনেক জমি বিলীন হয়েছে। সেই সব জমি নদীর উত্তর পাড়ে চর জেগেছে। আমরা ওই চর থেকে কিছু বালু তুলে বিত্রিু করছি। প্রশাসনের অনেকে তা জানেন।
“সব কটি ড্রেজারের আমার নেতৃত্বে চলছে। তবে বালু তোলার কারণে তীর রক্ষা বাঁধের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আর এখন বালু উত্তোলন বন্ধ আছে।”
অভিযোগ অস্বীকার করে নুরুজ্জামাল শেখ বলেন, “আমি বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত না। বরং আমি বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে সোচ্চার। সামনে আমি পৌরসভার নির্বাচন করব। তাই আমার প্রতিপক্ষ মিথ্যা অভিযোগ করেছে।”
নড়িয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধে গত নভেম্বরে ৮ দিন অভিযান চালিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আট ব্যক্তিকে ৪ মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৭ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া একটি খননযন্ত্র জব্দ করা হয়েছিল। এরপর কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও আবার নতুন করে বালু তোলা শুরু হয়।
এ বিষয়ে নড়িয়া উপজেলা সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. পারভেজ বলেন, “আমরা একাধিক বার অভিযান চালিয়েছি। বারবার জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে কয়েকজন শ্রমিককে সাজা প্রদান করেছি। তারপরও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করছে না একটি প্রভাবশালী মহল।”
আরও পড়ুন
পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধে ধস, সংস্কার নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের ঠেলাঠেলি
শরীয়তপুরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদী রক্ষা বাঁধে ধস
এক স্কুল তিনবার বিলীন পদ্মায়, এখন খোলা আকাশের নিচে ক্লাস
পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার ওপর হামলা