মাগরিবের নামাজের পর তার কফিন দাফনের জন্য সাভারের জিরানির উদ্দেশে রওনা হয়।
Published : 29 Mar 2023, 08:23 PM
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সত্তরের দশকের ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকীকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষজন। ঢাকা ও ঝিনাইদহে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানিয়ে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়।
বুধবার দুপুরে ঝিনাইদহ সরকারি বালক বিদ্যালয় মাঠে প্রথম জানাজার পর জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পুলিশের সুজ্জিত দল নূরে আলম সিদ্দিকীকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন।
বিকালে গুলশানে আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজার নামাজের পর ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাকীন মাসরুর খানের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে উঠে।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার ভোররাতে নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। সকালে তার মরদেহ হেলিকপ্টারে করে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা ও ‘গার্ড অব অনার’ শেষে ফের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ঢাকায় জানাজা ও গার্ড অব অনারের পর স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ডাকসুর ওই সময়ের ভিপি আ স ম আবদুর রব মরহুমের কফিনে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
আ স ম আবদুর রব তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা অসীম বাগ্মী ছিলেন। ষাটের দশকে তিনি তার এই বাগ্মী ভাষায় জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন।”
“এদেশ যতদিন থাকবে নূরে আলম সিদ্দিকী জাতির দেহের মধ্যে গ্রথিত থাকবেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।”
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের প্রতি তার অসীম বিশ্বাস ছিলো। আামি তার আত্মার শান্তি কামনা করি তাকে যেন আল্লাহুতালা বেহেস্তে নসিব করেন।”
মরহুমের কফিনে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, জেএসডির পক্ষে আ স ম আবদুর রব, শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন মরহুমের কফিনের পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
এর আগে গুলশানে তার কফিন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এলে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার জানাজায় অংশ নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষজন উপস্থিত হন।
নূরে আলম চৌধুরী গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ (আজাদ মসজিদ) ও ঈদগাহ সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।
সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল ফজল বুলবুল বলেন, “মসজিদের ১ এপ্রিল একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এটা নিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন।এরমধ্যে তিনি মারা গেলেন।”
“মরহুমের স্মরণে ১ এপ্রিল এই মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।”
সাবেক ছাত্রনেতা ইসমত কাদির গামাও হুইল চেয়ারে করে এই জানাজায় অংশ নেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে দীর্ঘ যুগের সম্পর্ক। রাজনীতির সময়ে নূরে আলম সিদ্দিকী, রব ভাই, মাখন ভাই আমরা সারা বাংলাদেশে একসঙ্গে ঘুরেছি। তারপরে পার্টিতে ডিভিশন হয়ে গেল।”
“নূরে আলম সিদ্দিকী অসাধারণ বক্তৃতা দিতে পারতেন। তাকে বক্তৃতার যাদুকর বলা হতো। নূরে আলম সিদ্দিকী বাকশালের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছেন। তখন স্পিকার তাকে বলেছিলেন, আপনি থামেন। আজকে তার মৃত্যুতে আমি ও জাতি একজন দেশপ্রেমিককে হারালো।”
জানাজার আগে মরহুমের দুই ছেলে তানজীব আলম সিদ্দিকী ও ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী সবার কাছে তাদের বাবার জন্য দোয়া চান।
তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, “নূরে আলম সিদ্দিকী ভয় এবং লোভের কারণে কোনোদিন সত্য বলতে বিরত থাকেননি। আমার বাবা আপোষহীন ছিলেন। আমার আব্বা যেটা বিশ্বাস করতেন, সেটাই করতেন।”
“আপনারা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এখানে এসেছেন। আপনাদের বলব, আপনারা নূরে আলম সিদ্দিকীকে মনে রাখবেন, যিনি আপোষ করেননি, যিনি সব অবস্থায় সত্য কথা বলতেন, যিনি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি। উনি গর্ব করে বলতেন, আমি মসুলমান, আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করবো না। আপনারা বাবার জন্য দোয়া করবেন।”
মাগরিবের নামাজের পর তার কফিন দাফনের জন্য সাভারের জিরানির উদ্দেশে রওনা হয়। সেখানে তৃতীয় দফায় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে।
এদিকে ঝিনাইদহে জানাজা ও গার্ড অব অনার শেষে নূরে আলম সিদ্দিকীর স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আব্দুল হাই, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিয়োদ্ধা মকবুল হোসেন, জেলা বিএনপি সভাপতি এম এ মজিদ।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ যে চার ছাত্র নেতাকে সে সময় ‘চার খলিফা’ হিসেবে অভিহিত করা হত তাদের অন্যতম ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৪০ সালের ২৬ মে ঝিনাইদহে। তিনি ঝিনাইদহ হাই স্কুল থেকে মেট্টিক পাস করেন। পরে ঝিনাইদহ কেসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
এরপর তিনি ঢাকা ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু রাজনীতির কারণে তাকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। এর পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
নূরে আলম সিদ্দিকীর বাবা নুরুন্নবী সিদ্দিকী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী স্কুল জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। তখন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী হন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরের ৭ জুন ৬ দফা আন্দোলনের একটি বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেন।
বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্বে উপস্থিত, সেই সময় ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে নূরে আলম সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক ছিলেন।
আরও পড়ুন: