“বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে… একদল গুজব ছড়িয়েছে, আরেকদল আক্রমণ করেছে”, বলেন তিনি।
Published : 27 Jul 2024, 06:15 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আর ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
ছাত্রদেরকে ‘ভুল পথে’ নিয়ে গিয়ে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে… একদল গুজব ছড়িয়েছে, আরেকদল আক্রমণ করেছে।”
এই ধরনের কাজ কেবল ‘ডেডিকেটেড ফোর্সরাই’ করতে পারে বলেও মন্তব্য করে মন্ত্রী জানান, এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে তার মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কামাল বলেন, “কয়েকদিনের ধ্বংসের লীলা খেলায় প্রমাণ হয়েছে, ছাত্ররা ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তারা জামায়াত, বিএনপি এবং জঙ্গি; যারা স্বাধীনতা চায়নি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসের উত্থান ঘটাতে চেয়েছিল, তাদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে গিয়েছে।”
খুব পরিকল্পনা করে কাজ করা হয়েছে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “একটি মহল সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এমন সব গুজব ছড়াচ্ছেন, যেগুলো শুনলে সাধারণ মানুষও ঠিক থাকতে পারেন না, বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
“একদল গুজব ছড়িয়েছে, আরেকদল আক্রমণ করেছে। এই রকম সংঘবদ্ধ আক্রমণ শুধুমাত্র ডেডিকেটেড ফোর্সরাই করতে পারে, যেটা নাকি জামায়াত, বিএনপি এবং জঙ্গিদের কাছে রয়েছে। আবার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।”
১৯ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত পুলিশের অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে গত ১৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা বিক্ষোভে চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতাসহ তিনজন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ছাত্রলীগ কর্মীসহ দুইজন এবং রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
এর প্রতিবাদে ১৮ জুলাই ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে হয় তুলকালাম। ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের সময় গুলিতে বেশ কয়েকজন ছাত্রের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়।
বিটিভি ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, সেতু ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারি স্থাপনার আগুন ধরিয়ে দেওয়া, ফায়ার সার্ভিসকে বাধা দানের মতো ঘটনা ঘটে। পরে হামলা হয় মেট্রোরেলে, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় দুটি স্টেশন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সংযোগ, জারি হয় কারফিউ। এর মধ্যেও ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরে সংঘাত চলতে থাকে।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নরসিংদী কারাগারের ফটক ভেঙে সব বন্দিকে বের করে লুট করা হয় অস্ত্র ও গুলি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই এক সপ্তাহের সংঘাত সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়ে গেছে।
সোমবার থেকে সংঘাত থামতে থাকে, তবে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে বুধবার, এখনও বন্ধ ট্রেন চলাচল। ইন্টারনেট ফিরলেও এর গতি সীমিত, আবার মোবাইল ইন্টারনেটও বন্ধ।
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগে অনেক মৃত্যু
মন্ত্রী বলেন, “ছাত্রদের মিসগাইড করে যে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা অনেকেই সাধারণ মানুষ।
“আমাদের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অনেকে শাহাদাত বরণ করেছেন। তিনজন পুলিশ, একজন আনসার শাহাদাত বরণ করেছেন। একজন পুলিশ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
“এক পুলিশ সদস্যকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।”
পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ করেছে দাবি করে কামাল বলেন, “এদের আক্রোশই ছিল এবং আওয়ামী লীগের প্রতি। যে পুলিশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সেই পুলিশের উপর তাদের আক্রমণ। বিজিবির উপরও তারা আক্রমণ করেছিল।
“র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি একত্র হয়ে যখন পারছিল না, তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার জন্য তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। সেনাবাহিনী কাজ করছে, শীঘ্রই আমরা এই অবস্থান থেকে পরিত্রাণ পাব।”
নরসিংদী কারাগারে হামলা নিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তারা জঙ্গিদের বের করে নিয়ে গেছে, অস্ত্র লুট করেছে। অস্ত্র ও জঙ্গি নেওয়ার উদ্দেশ্য আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারেন। জঙ্গি উত্থান যারা ঘটাতে চেয়েছিল তারাও এই আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে।
“অস্ত্রগুলি তারা আমাদের পুলিশের বিপক্ষে ব্যবহার করছে। আমাদের পুলিশ ও বিজিবি অত্যন্ত দক্ষ, দেশ প্রেমিক। কাজেই এরা এই সমস্ত জিনিসে ভয় করে না।”
এ সময় সারাদেশে সংঘটিত ‘ধ্বংসলীলা’ গণমাধ্যমে প্রচারের আহ্বান জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মেধা কার্যত ৯৮ শতাংশ
আপিল বিভাগের আদেশের পর ৭ শতাংশ কোটায় এবং ৯৩ শতাংশ মেধা তালিকা থেকে নিয়োগের বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।
তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৫ শতাংশ কার্যত অকার্যকর বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাদের সন্তানদের বয়স অলরেডি ৩০ বছর পার হয়ে গেছে। ৩০ বছরের নিচে এখন আর কেউ নাই।
“কাজেই এই মুক্তিযোদ্ধা কোটাও আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থাকবে না, এইটাও মেধায় চলে গিয়েছে। মানে এখন মেধায় ৯৮ শতাংশ।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী তিন মন্ত্রীকে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনজন মন্ত্রী ছাত্রনেতাদের নিয়ে বসেছিলেন, তাদের আট দফা দাবির কথা শুনেছেন। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেবেন, কিন্তু সেই সুযোগ তারা দেয়নি।”
তিন সমন্বয়ক নিরাপত্তা হেফাজতে
ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র তিন সমন্বয়ককে গোয়েন্দা হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “আমরা তাদের সেফ কাস্টডিতে নিয়েছি। তারা নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কিনা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলও মন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, পিবিআই কার্যালয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কয়েকটি স্থাপনা পরিদর্শন করেন।