খালটি কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জের ডাকাতিয়া নদী থেকে শুরু হয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে গিয়ে আরেকটি খালে মিশেছে।
Published : 10 Apr 2023, 07:20 PM
কেউ নির্মাণ করেছেন টিনের ঘর; আবার কেউ আরসিসি পিলার ঢালাই করে নির্মাণ করেছেন পাকা দোকান। খাল জুড়ে যেন চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। প্রভাবশালীদের এমন প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে কুমিল্লার শতবর্ষী বেরুলা খাল।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা ইউনিয়নের খিলা বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত এই খালটি প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কারণেই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বলে অভিযোগ বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের।
বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, “সরকার থেকে খালটি কোনো প্রকার লিজও দেওয়া হয়নি। এরপরও বাজারের উত্তর মাথা থেকে ও দক্ষিণ মাথা পর্যন্ত পুরো খালে অবৈধ দোকান ঘরের সারি দেখা যায়।
“প্রশাসন বিষয়টির দিকে নজর দেয় না। যার কারণে আমরা বাধা দিলেও দখলকারীরা শোনে না। প্রায় সময় দেখি খালের মধ্যে নতুন নতুন দোকান ঘর ওঠে। আমরা এসব বলে কী লাভ?”
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, খিলা বাজারের বুক চিরে চলে গেছে চারলেনের কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটি। মহাসড়কের পূর্বপাশে খালটির অবস্থান। একের পর এক দখলে খালটি সংকুচিত হয়ে কোথাও সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে, আবার কোথাও সেটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, খিলা বাজারটির প্রায় ৮০ শতাংশ পড়েছে মনোহরগঞ্জ উপজেলায়, বাকি অংশ পড়েছে পাশের লাকসাম উপজেলায়।
প্রাচীন এই বাজারের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খালের ওপর দেড় শতাধিক দোকান তুলেছেন প্রভাবশালীরা। কেউ নিজেরা ব্যবসা করছেন। আবার কেউ ভাড়ায় দিয়ে প্রতি মাসে টাকা তুলছেন।
এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও খাল দখলকারীরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য, তারা খাল দখলের বিষয়ে জানেন না। টাকার বিনিময়ে দোকান ভাড়া নিয়েছেন।
খালের উপর নির্মিত একটি দোকানে ফার্নিচার ব্যবসা করছেন মাসুদ আলম। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাস দুয়েক আগে মাসিক চার হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি নিয়েছি। দোকানটির মালিক লাকসামের রাজাপুর গ্রামের রহিম মিয়া।
“তিনি কীভাবে দোকান নির্মাণ করেছেন- সেটা আমি জানি না। আমি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছি।”
বেরুলা খাল দিয়ে প্রবাহিত পানি যুগের পর যুগ কৃষিকাজে ব্যবহার করেছেন কৃষকরা। তারা জানান, খালটি দখল হয়ে পড়ায় আশপাশের কয়েকশ হেক্টর কৃষি জমিনে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
খিলা এলাকার কৃষক মাইন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক যুগ আগেও এই খালের পানি দিয়ে ইরি-বোরো আবাদ করেছি। এখন আর সেটি সম্ভব হয় না। পুরো খালটি দখল হয়ে গেছে। বরং বর্ষা মৌসুমে খালটিতে পানি জমে চারদিকের ফসলি জমিতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
“প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত এক দশক ধরে খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলেছে। এখন বাধ্য হয়ে আমরা পুকুর-ডোবা বা মাটির নিচের পানি (ভূগর্ভস্থ পানি) উত্তোলন করে চাষাবাদ করি।”
জানা গেছে, বেরুলা খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশের ফতেপুর গ্রামে ডাকাতিয়া নদীতে এর উৎসমুখ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে খালটি নোয়াখালীর চৌমুহনীতে গিয়ে আরেকটি খালে মিশেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই খালটি ভরাট করে আসছে প্রভাবশালীরা। গত কয়েক বছরে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন অংশে খালটি ভরাট করে দোকানের পাশাপাশি বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। এতে কোথাও কোথাও খালটি পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেখানে খালটি ভরাট বন্ধ ও দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা, সেখানে উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিগত সময়ে খালটি দখল করেছে।
“বিশেষ করে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটির চার লেন প্রকল্প যেন খাল ধ্বংসের প্রকল্প। ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়কটি বর্ধিত করতে গিয়ে খালটির অধিকাংশ স্থানই ভরাট করা হয়ে গেছে।”
“লাকসাম পৌরসভার দক্ষিণে বাতাবাড়িয়া ও ভাটিয়াভিটা এলাকায় গেলে এখন কেউ বলতে পারবে না এখানে আগে খাল ছিলো। এতে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।”
স্থানীয় প্রবীণ বাবুল হোসেন বলেন, বেরুলা খালটি ডাকাতিয়া নদীর অন্যতম প্রধান শাখা খাল। এ খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন শাখা খালের।
এক সময় এই খালটির ওপর নির্ভরশীল ছিলো কুমিল্লার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জ উপজেলার তিন সহস্রাধিক একর কৃষি জমির আবাদ।
তিনি আরও বলেন, খালটি ভরাট আর দখল হয়ে যাওয়ায় খাল পাড়ের এলাকাগুলোতে ইরি-বোরো মৌসুমে সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছও এখন আর মিলে না খালে।
পুরোনো দিনে স্মৃতি হাতড়ে আরেক প্রবীণ মনোহরগঞ্জের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক সময় এই খালে পাল তোলা নৌকা চলত। এই খাল দিয়ে লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজার থেকে নৌকায় নোয়াখালীর চৌমুহনী বাজার পর্যন্ত মালপত্র আনা-নেওয়া হতো।
“কিন্তু খিলা বাজারের মতো এভাবে বিভিন্ন স্থানে দখল এবং অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্ট নির্মাণে খালের নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দেড় যুগ আগেই।
এই বয়োঃবৃদ্ধ আফসোস করে বলেন, “কয়েক বছর আগেও খালটির টলটলে পানিতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন স্থানীয় জেলেরা। সেই খাল এখন নামে আছে, বাস্তবে নেই।”
তবে অবৈধভাবে পুরো খালটি দখলের বিষয়টি জানা নেই বলে জানান মনোহরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম কমল।
তিনি বলেন, “বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি। এরপর শিগগিরই খালটি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”