“পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে মাছ চাষ করেছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে মাছের ঘের ভেসে গেছে।”
Published : 29 May 2024, 05:02 PM
স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার তাড়াইল গ্রামের দীনবন্ধু গাইনের সংসার। ছেলে অনার্সে পড়ে আর মেয়ে এবছর এইচএসসি পাস করেছে।
সংসারের আর্থিক অনটন কাটাতে এ বছর ঋণ করে ৩০ বিঘা ঘেরে মাছের চাষ করেছিলেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ঘের ভেসে যাওয়ায় এখন সর্বশান্ত তিনি। ঋণ কিভাবে শোধ করবেন, সেই চিন্তায় এখন দিশেহারা দুই সন্তানের এ জনক।
তারাইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাছের ঘেরের পাড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন দীনবন্ধু। তার অপলক দৃষ্টি ঘেরের দিকে।
কথা বলতে গিয়ে দীনবন্ধুর চোখের একপাশ ভিজে উঠছিল; একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, “সংসারের অভাব-অনটন কাটাতে মাছের চাষ করেছিলাম। ভেবেছিলাম এই মাছ অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। লাভ হবে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো।
“আর কয়েকদিন বাদে এসব মাছ বিক্রির জন্য ঘের থেকে ওঠানো হতো। কিন্তু সবকিছুই শেষ করে দিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। অনেকেই ঘেরে নেট দিয়ে, বাঁধ দিয়ে মাছ ভেসে যাওয়া ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।”
দীনবন্ধু বলছিলেন, “স্ত্রী সন্তান নিয়ে এখন কীভাবে সংসার চলবে সেই চিন্তা করে কূল পাচ্ছি না। সরকারি সহযোগিতা না পেলে মরণ ছাড়া আমার আর কোনো গতি থাকবে না।”
শুধু দীনবন্ধু নয়; তার মত একই অবস্থা টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তত সহস্রাধিক মাছ চাষির।
এমনটাই বলছিলেন, গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজন কুমার নন্দী।
বিজন বলেন, “ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে অতিরিক্ত জোয়ার ও বৃষ্টিপাতে গোপালগঞ্জ জেলার সদর, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার ১ হাজার ৫১০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এর মধ্যে টুঙ্গিপাড়ায় ১ হাজার ৫৫টি, কোটালিপাড়ায় ৩৩৫টি ও সদর উপজেলায় ১১০টি মাছের ঘের রয়েছে।
“ভেসে যাওয়া ঘেরের মোট আয়তন ৬০৩ হেক্টর; সেখান থেকে ৬৬৬ মেট্রিকটন মাছ ভেসে গেছে।”
ভেসে যাওয়া মাছের মধ্যে ৫৯৭ দশমিক ৪৯ মেট্রিকটন কার্প জাতীয় মাছ, চিংড়ি ৬৮ দশমিক ৫১ মেট্রিকটন, পোনা ২৯ লাখ পিস ও চিংড়ি ৬ দশকিম ৩১ লাখ পিস রয়েছে বলে জানান এ মৎস্য কর্মকর্তা।
বিজন কুমার নন্দী বলছেন, “রোমালে জেলার সহস্রাধিক চাষির অন্তত ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের সহায়তা করার জন্য সেখানে সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার কোনো বরাদ্দ দিলে তা চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।”
তাড়ালই গ্রামের ভবসিন্ধু গাইনও অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে মাছের চাষ করেছিলেন। কিন্তু রেমালের আঘাতে সব হারিয়ে এখন দিশেহার হয়ে ফিরছেন।
তিনি বলেন, “আমার সংসারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। সংসারের অভাব কাটাতে ১৭ বিঘা ঘেরে কার্প ও চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করেছিলাম। মাছের যে সাইজ হয়েছে, তা ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারতাম। তাতে আমার অন্তত ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাভ হতো।
“কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমার সব কেড়ে নিয়েছে। মাছ হারিয়ে এখন চোখে-মুখে সরষের ফুল দেখছি।”
একই দশা ওই উপজেলার অরবিন্দু গাইন ও অর্চনা গাইন দম্পত্তির। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তারা।
অরবিন্দু গাইন বলেন, “পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে মাছ চাষ করেছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে মাছের ঘের ভেসে গেছে। এখন আমার ঘেরে দশ হাজার টাকার মাছও নেই।”
নিজেদের জমানো টাকা, ধার-দেনা আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে লাভের আশায় মাছ চাষ করেছিলেন আরেক চাষি অমৃত গাইন।
ঘূর্ণিঝড়ের পর তার সোনালি স্বপ্ন ফিকে হয়েছে। আবার সব হবে চারপাশের এমন সান্ত্বনা বাক্যের মাঝে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে-“ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব সব স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।”
খোকন গাইন নামের আরেক মাছ চাষি বলছিলেন, “অনুদান দিয়ে আমাদের আবার মাছ চাষের সুযোগ করে দেওয়া জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে আমাদের পথে বসতে হবে।”