“আজাদ সিদ্দিকী উপজেলা চেয়ারম্যান হলে কালিহাতী সন্ত্রাস- চাঁদাবাজ মুক্ত হবে। সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান হিসেবে কালিহাতী মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াবে।”
Published : 20 May 2024, 09:39 AM
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মাত্র একজন প্রার্থী হয়েছেন। ভোটের মাঠে নিজের দলের আর কেউ তার সঙ্গে টক্করে না গেলেও মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে আলোচিত সিদ্দিকী পরিবারের শামীম আল মনসুর (এসএএম) সিদ্দিকী ওরফে আজাদ সিদ্দিকী।
চেয়ারম্যানের চেয়ারে কে বসবেন? কয়েকজন ভোটারদের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর মিলেছে তাতে আঁচ করা যায়, এখানে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী মূলত সিদ্দিকী পরিবার।
সিদ্দিকী পরিবার বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো, কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জয়ী হয়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আরও ‘সুসংহত’ করতে চাইছে।
কালিহাতীর রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের ‘প্রভাব’ থাকলেও আওয়ামী লীগ তাদের আধিপত্য ‘রোধ’ এবং দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে ‘মরিয়া’ হয়ে মাঠে নেমেছে।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী ফরমান হোসেন বলেন, “কালিহাতী উপজেলা নির্বাচন জমে উঠছে। এই নির্বাচন মূলত আওয়ামী লীগ ও সিদ্দিকী পরিবারের মধ্যে। দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে মনে হচ্ছে।”
কালিহাতী পৌরসভার সাতুটিয়া গ্রামের গাজী বলেন, “আমরা নির্বাচনে আজাদ সিদ্দিকীকে সমর্থন করছি। আজাদ ভাই, সত্যিকারের ভালো মানুষ। তাকে সমসময় জনগণের পাশে পাওয়া যাবে। আমরা তাকে মন থেকে নির্বাচিত করতে চাই। তার জন্যই কালিহাতীর পূর্বাঞ্চলের মানুষ এক হয়েছে।
“আজাদ সিদ্দিকী আনারস প্রতীকে বিপুল ভোটে পাশ করবে বলে আমি আশা করি”, যোগ করেন তিনি।
আজাদ সিদ্দিকী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই। তিনি উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন আনারস প্রতীকে।
সিদ্দিকী পরিবারের ছোট ছেলে আজাদ এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা। সরকারি সা’দত কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সহসভাপতির (ভিপি) দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
আজাদ সিদ্দিকীর সঙ্গে মূলত যার লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লা। নির্বাচনে তার প্রতীক মোটরসাইকেল।
আজাদের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী কালিহাতীর বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী। তিনি মাঠে রয়েছেন দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে।
বাসিন্দা ইউনিয়নের পাঁচ জোয়ার গ্রামের খলিলুর রহমান আজাদকে চান কালিহাতীর চেয়ারম্যান হিসেবে।
কারণ কী? জানতে চাইলে খলিলুরের ভাষ্য, “আজাদ সিদ্দিকী উপজেলা চেয়ারম্যান হলে কালিহাতী সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ মুক্ত হবে। সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান হিসেবে কালিহাতী মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াবে। মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।”
নারান্দিয়া ইউনিয়নের মালতি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম আনোয়ার মোল্লার পক্ষে। আনোয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান হলে আওয়ামী লীগ টিকে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
জাহাঙ্গীর বলেন, “আনোয়ার মোল্লা যদি উপজেলা চেয়ারম্যান না হতে পারেন তাহলে কালিহাতীতে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হবে। আমাদের এমপি হয়েছেন স্বতন্ত্র। এবার চেয়ারম্যান হিসেবে দাঁড়িয়েছে তার ছোট ভাই। তাহলে আওয়ামী লীগ কোথায় যাবে। আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে হলে আনোয়ার মোল্লাকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমরা চাই।”
নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর আজাদ সিদ্দিকীর পক্ষে বেশ কয়েকটি নির্বাচনি সভায় ভোট চেয়েছেন ভাই কাদের সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিচ্ছেন না। তবে ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকীর প্রতি তার সমর্থন রয়েছে বলে ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন।
সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব পান। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ লাভ করেন। ২০১৪ সালে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়।
লতিফ সিদ্দিকী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তার পাশে ছিলেন ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী। এবার আজাদ তার বড় দুই ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
আজাদ রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও উপজেলা নির্বাচনের মাঠে পা রেখেছেন এই প্রথম। ভোটারদের সাড়া কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, কালিহাতীর প্রতিটি অঞ্চলের ভোটারদের কাছ থেকে তিনি ‘ব্যাপক’ সাড়া পাচ্ছেন। প্রতিটি এলাকার মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে আশা করি, জয়ী আমিই হব।”
এদিকে আনোয়ার হোসেন মোল্লা দিনরাত এক করে গণসংযোগ চালাচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতারা তার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন।
সাবেক সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারি, কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার আলী, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আবু নাসেরসহ বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা আনোয়ার মোল্লাকে বিজয়ী করতে কাজ করছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে পেয়ে জয়ের বিষয়ে আশাবাদী আনোয়ারও।
তিনি বলেন, নির্বাচনের কারণে তিনি দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীকে এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন এটাও তার জন্য এক প্রকার বিজয়। উপজেলার জনগণের কাছ থেকে ‘ব্যাপক সাড়া’ পাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে আছেন। এজন্য ভোটাররা তাকেই নির্বাচিত করবে।
ভোটে জিততে আজাদকে বাধা মনে করেন কি-না জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, “আজাদ তো নির্বচনে এসেছেন লতিফ সিদ্দিকীর কারণে। আজাদ কেন? কেউই আমাকে হারাতে পারবে না। আমি জয়ের ব্যপারে শতভাগ আশাবাদী।”
কালিহাতী উপজেলা বাংড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাগুটিয়া গ্রামের সোহরাব আলী বলছিলেন, “আওয়ামী লীগের লোকজন যদি তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করতে পারে তাহলে আনোয়ার হোসেন মোল্লা পাশ করবে। আমি আশা করি, তিনি বিপুল ভোটে পাশ করবেন।”
কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “যেহেতু এখানে নৌকা প্রতীক নাই, তাই সাবেক এমপি সোহেল হাজারীসহ আমরা আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দিয়েছি। বর্তমান এমপি লতিফ সিদ্দিকী তার ভাই আজাদ সিদ্দিকীর পক্ষে সমর্থন দিলেও সরাসরি নির্বাচনের প্রচার কাজে অংশগ্রহণ করেননি।”
কালিহাতী উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন ও সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা হলেন- উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান (টিউবওয়েল), মো. আব্দুল্যাহ সরকার (চশমা), মো. আব্দুল বারেক (উড়োজাহাজ), মো. মাহমুদুল হাসান দীপুল (তালা) ও জমীর উদ্দিন আমেরী (বই)।
সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রীনা পারভীন (প্রজাপতি) ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিক ফাতেমা খাতুন বৃষ্টি (ফুটবল)।
দুইটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কালিহাতী উপজেলায় মোট ভোটার তিন লাখ ১২ হাজার ১১২জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫ জন। আর নারী ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭০৭ জন।