২০১২ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়; বরখাস্ত হওয়ার ১০ বছর পর ২০২২ সালে তিনি চাকরি ফিরে পান।
Published : 12 Jul 2024, 12:51 AM
‘সততার কারণে’ স্বাধীনতা-উত্তরকালে পিএসসিতে পিয়ন পদে চাকরি পেয়েছিলেন বাবা; তারই পোষ্য কোটায় একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে দুইবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে নাম জড়ায় ছেলে খলিলুর রহমানের।
১০ বছর আগে প্রথমবার প্রশ্নফাঁসে জড়িয়ে চাকরি খোয়ান। পরে আপিলে ‘নির্দোষ’ হয়ে ফের চাকরিতে ফেরেন এই অফিস সহকারী।
এবার আবার পিএসসির আলোচিত সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ওরফে জীবনসহ আরও ১৬ জনের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন অডিট ডেসপাস খলিলুর। তার বড় ভাই হাবিবুর রহমানও পোষ্য কোটায় একই প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত আছেন।
খলিলুরের পৈত্রিক বাড়ি মূলত যশোরের কেশবপুরে; তবে পরিবারটির অধিকাংশ সদস্যই খুলনায় বসবাস করেন। চাকরিসূত্রে খলিলুর রহমান ঢাকায় থাকেন। খুলনা ও যশোরে পৈত্রিক বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো সম্পদের হদিশ না মিললেও ঢাকায় তার একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
একটি চক্র প্রায় এক যুগ ধরে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বলে ছয়জনের ছবিসহ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রোববার প্রচারিত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে।
এরপরেই সিআইডি তদন্ত করে ওই ছয়জন ছাড়াও অন্য যাদের নাম পেয়েছে অভিযানে নেমে খলিলুর রহমানসহ মোট ১৭ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালকও আছেন।
এ ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলা হয়। যার তদন্ত সিআইডি করছে। এর মধ্যে খলিলুর রহমানসহ ছয়জন মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পিএসসি এরই মধ্যে তাদের পাঁচজনের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে চিঠি দিয়েছে।
সম্পদের ব্যাপারে জানতে চাইলে খলিুলুর রহমানের মা রোখসানা বেগম বৃহস্পতিবার বলেন, খুলনার বয়রা এলাকার একতলা বাড়িটি খলিলুরের বাবা করে গেছেন। যশোরের বাড়িটিও একতলা। এর বাইরে এখানে খলিলুরের কিছু নেই।
তবে খলিল ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছে জানিয়ে রোকসানা বলেন, তিনি দু-তিনবার সেই ফ্ল্যাটে গিয়েছেন। তবে সেই এলাকার নাম তিনি বলতে পারেননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, খলিলুরের ফ্ল্যাটটি মিরপুরের ৬০ ফিট রোডে। একটি আটতলা ভবনের সাততলায় তার ফ্ল্যাট। সেটি বেশ পরিপাটি। বুধবার কয়েকজন সাংবাদিক সেখানে গিয়ে দেখতে পান, বাসায় খলিলুরের ভাই-বোন অবস্থান করছেন।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার রাতে এই বাসা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খলিলুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তিনি মোটরসাইকেলে করে অফিসে যাতায়াত করতেন। সেই মোটরসাইকেলও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে।
পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, খলিলুর রহমানের মূল বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট ইউনিয়নের পাচারই গ্রামে। তার বাবা নাজিম উদ্দিন পিএসসিতে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতেন।
পাচারই গ্রামের বাসিন্দা এবং খুলনার নূরনগর ওয়াপদা মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, নাজিম উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের আগে যশোরের রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য মসিয়ুর রহমানের বাড়িতে গৃহ-সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে মসিয়ুর রহমান শহীদ হন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে মসিয়ুর রহমানের স্ত্রী অধ্যাপক মাহমুদা রহমান পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। মূলত তার সুবাদেরই নিজাম উদ্দিনের পিএসসিতে চাকরিটি হয়।
শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, “আমি যখন খুলনার আযম খান কলেজে পড়ি তখন খলিলের বাবা নিজাম উদ্দিন কর্মকমিশনের খুলনার অফিসে চাকরি করতেন। তিনি সৎ মানুষ ছিলেন। সেই কারণেই তিনি চাকরি পেয়েছিলেন।”
নিজাম উদ্দিন পাঁচ-ছয় বছর আগে মারা গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “খলিল লেখাপড়ায় ভালো ছিলো না। তবে তাদের অন্য ভাই-বোনদের ব্যাপারে অসততার কিছু শুনিনি। এখন সে কী করেছে জানি না। তাদের সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু নেই।”
প্রায় একই ধরনের কথা বলেন অপর প্রতিবেশী আসাদুজ্জামান তাহের।
বুধবার পাচারই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খলিলুরদের বাড়িতে তাদের ভিটায় একটি জীর্ণ ঘর রয়েছে। সেখানে বসবাস করেন তার ছোট চাচা নেছার উদ্দিন। তিনি পেশায় কৃষক।
নেছার উদ্দিন জানান, চাকরি সূত্রে প্রায় সারা জীবনই তার ভাই নিজাম উদ্দিন খুলনায় বসবাস করেছেন। সেখানেই তিনি বিয়ে করেন। শ্বশুরের দেওয়া জমিতে বসবাস করেছেন।
নাজিম উদ্দিনের সন্তানরা গ্রামের বাড়িতে খুব একটা আসেন না। তবে নাজিম উদ্দিন বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝেই আসতেন। সঙ্গে স্ত্রীও আসতেন। নাজিম উদ্দিনের মৃত্যুর পর স্ত্রীও আর তেমন আসেন না।
নেছার উদ্দিন বলেন, “খলিল দুর্নীতি করলে তার তো অনেক টাকা থাকতো। তাতো কখনও দেখিনি। খুলনায় তার বাবার করে যাওয়া একতলা বাড়িতে তারা এখনও থাকে। এর আগেও বছর দশেক আগে একবার দুর্নীতির অভিযোগে খলিলুরের চাকরি গিয়েছিল। পরে আবার তা ফিরে পায়।
তিনি বরং ক্ষোভ নিয়ে বলেছিলেন, “দুর্নীতি করে অফিসাররা, আর দোষ হয় কর্মচারীর।”
পাচারই গ্রামের প্রতিবেশী তানিয়া বেগম ঝর্ণা বলেন, “খবরে এই দুর্নীতির কত কত টাকা দেখছি এক ড্রাইভারের। কিন্তু খলিলের মা যখন গ্রামে আসে তখন তার পোশাক কাজের মহিলার চেয়েও খারাপ দেখি। জানি না ঘটনা সত্যি না মিথ্যা।”
খলিলের চাচি নেছার উদ্দিনের স্ত্রী পারুল বেগম বলেন, “জানি না ছেলেটার কী হয়েছে।”
এদিকে খুলনায় খলিলদের বাড়িটি নগরীর রায়েরমহল এলাকায়। সেখানে গিয়ে একটি একতলা বাড়ি দেখা গেছে।
সেখানে গিয়েই খলিলুরের মা রোকসানা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, খলিল পোষ্য কোটায় ২০০৮ সালের দিকে পিএসসিতে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পান। পরের বছর পোষ্য কোটায় পিএসসিতে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে খলিলের বড় ভাই হাবিবুর রহমানের চাকরি হয়।
ওই এলাকার বাসিন্দা মফিজ মোল্লা বলেন, তারা মূলত যশোরের লোক। রায়েরমহল খালপাড়ে নিজাম উদ্দিনের ১৫ শতক জমিতে একতলা ভবন ছিল। ওই জমিতে সম্প্রতি খলিলুর রহমান চার কক্ষবিশিষ্ট একতলা একটি বাড়ি করেছেন। তবে ওই বাড়িটিতে কেউ থাকে না, বাড়িটি ভাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
মফিজের ধারণা, খলিল যে বাড়িটি তৈরি করেছেন তাতে অন্তত ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, খলিল এখানে তেমন একটা আসেন না। ঢাকাতেই থাকেন। তবে তাদের পরিবা সাধারণ। কোনো চাকচিক্য চোখে পড়েনি।
জানা যায়, ২০১২ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। তখন তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে পিএসসি। র্যাবের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। একই সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়। ২০২২ সালে তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
তবে এ ব্যাপারে পরিবারের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
খলিলের ভাবী ফাতেমা বেগম জানান, খলিল পাঁচ বছর আগে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রামে বিয়ে করে। তার কোনো সন্তান নেই।
তিনি বলেন, ঈদের সময় খলিল বাড়িতে আসেন। এ ছাড়া তেমন একটা আসেন না।