ভ্যালেন্টাইন টোনাটুনি

আবুধাবির একটি হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অদ্ভুত এক প্রেমের কাহিনীর সাক্ষী হয়েছিলেন লেখক। 'ভ্যালেন্সটাইন ডে' উপলক্ষে আশ্চর্য সে-ই গল্পটি তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে।

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 13 Feb 2023, 05:11 PM
Updated : 13 Feb 2023, 05:11 PM

অনেক বছর আগে, ব্যতিব্যস্ত কাজ করছি আবুধাবী সেন্ট্রাল হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের অফিসে- ল্যাবের ভেতর ব্যতিব্যস্ত আমার টেকনিশিয়ান টেকনোলজিস্টের দল।

ফোন বাজলো, ওধারে একজন নারীর কণ্ঠ- হাসান মাহমুদ বলছেন?

- বলছি !...

- একজনের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর পেয়েছি. আমাকে একটু হেল্প করতে হবে।

হাসি পেল। হাসপাতাল এমন একটা জায়গা, সবাইকে কখনো না কখনো এখানে আসতেই হয়। আমার ওপরে আবুধাবির শুধু বাংলাদেশিরা নন, পশ্চিমবঙ্গসহ পুরো বাঙালি সমাজের অখণ্ড অধিকার, নানা রকম 'হেল্প করা' আমার লেগেই আছে। ছোটখাটো আইনও ভাঙতে হয় কখনও কখনও। বললাম - বলুন!

- আমি গতকাল ঢাকা থেকে এখানে ছেলের সংসারে এসেছি, আগামী সপ্তাহে ফিরে যাব। এক পেশেন্টকে দেখতে চাই ।

- চলে আসুন ভিজিটিং আওয়ারে, কোনো অসুবিধে নেই।

- ভিজিটিং আওয়ারে না। আমি আসতে চাই যখন বাইরের কেউ থাকবে না।" 

একটু ধাক্কা খেলাম। বললাম – কোনও পেশেন্ট?

 নাম শুনে চুপ হয়ে গেলাম। পেশেন্ট বাংলাদেশি, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গভীর কোমায়, লাইফ সাপোর্টে আছেন। এখানে তার স্ত্রী-সন্তানরা আছেন, আমার ল্যাবের রিপোর্ট বলছে জীবনের আর কোনও আশা নেই, ডাক্তারেরাও জবাব দিয়ে দিয়েছে।

বললাম- উনি তো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, ওখানে অনেক রেস্ট্রিকশন!

মিনতিভরা কণ্ঠে তিনি বললেন– দেখুন, উনাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য আমি এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। অফিস ছুটি দিচ্ছিল না, রিজাইন করে এসেছি। প্লিজ, প্লি-জ একটা ব্যবস্থা করে দিন।

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো - চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন?

- কী করবো– ছুটি দিচ্ছিল না। আমার এত বছরের চাকরি !

মনে হলো ভদ্রমহিলার দাবি উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়।

বললাম- যখন বাইরের কেউ থাকবে না... তাহলে তো মাঝরাতে আসতে হয়।

- তাই আসব।

- রাত বারোটায় আসুন - আমি ইমার্জেন্সির গেটে থাকব।

- আচ্ছা। আমি সবুজ শাড়ি পরে আসব, চিনতে পারবেন। 

রাত বারোটায় তিনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন, সবুজ শাড়ি পরা। আইসিইউ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাসিমুখে ছুটে এলো হেড নার্স সুমাইয়া, বললো- কী ব্যাপার বিগ ব্রাদার, এত রাতে?

বললাম- পেশেন্ট দেখতে এসেছি।

সুমাইয়া মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গেল।

নাকেমুখে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে লাগানো নানা রকম পাইপ আর টিউব, ধীরে বইছে নি:শ্বাস। চোখদুটো আগের মতোই বন্ধ। সরু টিউবের ভেতর দিয়ে হাতের সুঁচ দিয়ে শরীরে ঢুকছে টিপিএন ফ্লুইড, টোটাল প্যারেন্টারেল নিউট্রিশন। আস্তে তিনি বসলেন বেডের পাশে চেয়ারে। পেশেন্টের হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন- টোনা! শুনতে পাচ্ছ? আমি তোমার ছোটবেলার টুনি।

টোনা! ছোটবেলার টুনি! আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আর পুরো আকাশটাও যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আমার মাথার ওপর। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি। এ শরীর এতদিন বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি শত আহ্বানে, তার বন্ধু-বান্ধবের, স্ত্রীর, এমনকি সন্তানদেরও। সেটা এখনো পড়ে আছে একই রকম নিষ্প্রাণ। ওই শরীর, ওই মন কি আর কখনো কারো ডাকে সাড়া দেবে?

তিনি ফিসফিস করে বললেন- তোমার অসুখের কথা শুনে ঢাকা থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি।

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট। ওটা মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা নাকি জীবন্ত শরীরে মৃত আত্মা, বলা কঠিন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই নিথর দেহের অতলান্তে নড়তে শুরু করেছে সুগভীর মায়াময় বাল্যপ্রেম।  

পেশেন্টের পাশে বসা নারী গভীর মমতায় ফিসফিস করে বললেন- আমি জানি, তুমি শুনতে পাচ্ছ! আমি জানি আমার কথা না শুনে তুমি পারবে না। সেই সবুজ শাড়িটা তুলে রেখেছিলাম! এত বছর পর আজ আবার পরেছি।

অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোন সুদূর অতীত থেকে কত বছরের ক্ষুধার্ত বাল্যপ্রেম ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো হতচেতন দেহের ভেতরে। থরথর করে কেঁপে উঠল দেহ, নড়ে গেল নাক-মুখের পাইপ, হাতের সুঁচ নড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম- ‘সুমাইয়া…’

ছুটে এলো নার্সের দল। কিন্তু সেই ভূমিকম্প থামায় কার সাধ্য। ভদ্রমহিলা ধরে আছেন তার হাত।

কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, শান্ত হও, শান্ত হও টোনা! আমি তোমার পাশে আছি তো... তোমার টুনি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যায়নি ... শান্ত হও...!

কি এক নিবিড় প্রশান্তিতে স্থির হয়ে এল দেহ, রুদ্ধশ্বাসে আমি তাকিয়ে আছি। পেশেন্টের হাতের একটা আঙুল থিরথির করে কাঁপছে। তার শৈশবের টুনিকে কিছু বলতে চাইছে বুঝি!

ভদ্রমহিলা অনেক আদরে সেই আঙুলটা ছুঁয়ে রইলেন, মনে হলো যেন দুটো টোনাটুনি পাখি ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জীবনের শেষ কথা বলছে। এদিকে নার্সের চোখে ফুটে উঠেছে বিরক্তি ও মিনতি। ভদ্রমহিলা সেটা বুঝলেন। ক্ষুধার্তের মতো, বুভুক্ষুর মতো হাত বোলালেন অচেতন রোগীর বুকে, চোখে মুখে গালে কপালে, তারপর অত্যন্ত দ্রুত পেশেন্টের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে খুব নিচুস্বরে কী যেন বললেন।

কী বললেন তিনি? কী বললো এক আদরের টুনি তার আদরের টোনাকে জীবনে শেষবারের মতো?

আমি জানিনা। কেউ তা জানবেনা কোনোদিনই।

তারপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে গভীর নি:শ্বাস ফেলে বললেন, "চলুন"।

বাইরে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সে চোখে ফুটে উঠেছে অনুরোধ। আস্তে করে বললাম – "কেউ জানবে না।"

ভদ্রমহিলা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে যেন নিজের মনে বললেন - "আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না”। তারপর একটু থেমে বললেন – “আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ"।

আমি চুপ করে রইলাম, ট্যাক্সি চলে গেল।

আজ এই এতো বছর পরেও আমি যেন এখনো পাথরের মূর্তির মত হতবাক দাঁড়িয়ে আছি রহস্যময় সেই দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির বালুর ওপর .... সেই মাঝরাতে খোলা আকাশের নিচে...।

***

পেশেন্টের লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়েছিল পরদিন, তিনি চলে গিয়েছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে। এই কয়টা দিন হয়ত জীবনের শেষবারের মতো তার ছোটবেলার টুনির কণ্ঠ শোনার এবং স্পর্শ পাবার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।