কায়রোর চিঠি: তূর পর্বতের যতকথা

ঐতিহ্যের দেশ মিশর কিংবা সভ্যতার দেশ মিশর বলতে প্রচলিত একটা কথা আছে। কথাটার সত্যতা যাচাই হবে যখন আমরা তূর পর্বত নিয়ে আলোচনা করবো অথবা তূর পর্বত ভ্রমণে বের হবো।

মোহাম্মাদ আবু জাবের, মিশরের কায়রো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2018, 07:12 AM
Updated : 14 Sept 2018, 07:21 AM

মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান বলুন, উভয় জাতির নিকটই এই পর্বতটির আলাদা গুরুত্ব আছে। এর ধর্মীয় তাৎপর্য নানামুখী। কারণ নবী হযরত মূসা (আ.) এর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই পর্বতটি। তার নবুওয়ত লাভ, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাওরাত প্রাপ্তি, মহান আল্লাহর সঙ্গে কথাবলাসহ কত কত স্মৃতি! স্মৃতিতে ভাস্বর এই পবিত্র অঞ্চল।

পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আত-ত্বীনে এই পর্বতটি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরা-আন-নাযিয়াত (আয়াত নং-১৫-১৬) এবং আত-ত্বহায় (আয়াত নং-১২) সিনাই অঞ্চলকে পবিত্র ভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং ৮০ নং আয়াতে সরাসরি পর্বতটির নাম আছে। সূরা আল-বাক্বারায় (আয়াত নং-২৬০) এর উল্লেখ আছে। সূরা আল-আ’রাফে (আয়াত নং-১৪৩, ১৭১) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক আয়াতে মহান আল্লাহ এ পবিত্র ভূমি ও পর্বতটি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কোনো এক কাকডাকা ভোর। তখন পূর্ব গগনে সূর্যোদয় হতে খানিক বাকি। প্রকৃতির নীরবতায় ও নিস্তব্দতায় আমরা বের হলাম এই ‘তূর পর্বত’ ভ্রমণে, মিশরের ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন’ এর আয়োজনে। সঙ্গে ছিলেন স্বদেশি দেড়শোর মতো বন্ধু-বান্ধবদের একটি কাফেলা। ভ্রমণের সময় দীর্ঘ দু’দিন একরাত। অর্থাৎ আজ সকাল থেকে শুরু হলে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা সিনাই অঞ্চলে পৌঁছবো। রাতব্যাপী পর্বতারোহন শেষে পরদিন সকালে হবে প্রত্যাবর্তন।

তখন ছিলো শীতের সকাল। কনকনে শীতে শরীর নেতিয়ে যাচ্ছিলো। মরুর দেশ হওয়ায় স্বভাবতই শৈতপ্রবাহের পরিমাণও বেশি হয়। তাই ঘন কুয়াশা ভরা প্রকৃতি। শিশির ভেজা ঘাস আর আকাশে ছল ছল মেঘ। সেই সঙ্গে পরিবেশের দুখিনী দুখিনী ভাব। আমরা ভারি জামা-কাপড় পরে গাড়িতে উঠলাম। ব্যাগভর্তি নিলাম আরো কয়েক সেট। কায়রোর অবস্থা দেখে অনুমান করলাম সিনাই অঞ্চলে শীত কেমন পড়তে পারে। স্বভাবতই এখানকার তুলনায় কয়েকগুন বেশি হবে। আর তূর পর্বত হয়ত বরফে ঢাকা পড়ছে। বরফে ঢাকা তূর পর্বত দেখার দৃশ্য মন্দ হবে না। মনে মনে তাই ভেবে অনেক খুশি হলাম।

তূর পর্বত মিশরের সিনাই উপদ্বীপে অবস্থিত। ভৌগলিক দিক থেকে এই সিনাই উপদ্বীপটির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একমাত্র স্থলভাগ যাতে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ পরস্পর মিলিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মিশরসহ গোটা আফ্রিকা মহাদেশের মানুষ এই অঞ্চল দিয়ে সিরিয়া, হিযায ও প্রাচীন রোম পারস্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতো। কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের জন্য এসব অঞ্চলের জন্য এই উপদ্বীপটির অসীম গুরুত্ব।

৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের মিশর বিজয়ের প্রাক্কালে সেনাপতি আমর বিন আস (রা.) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী এই সিনাই হয়েই মিশরে প্রবেশ করেন এবং বাইজেন্টাইনদের প্রতিরোধ মোকাবেলা করেন। দ্বাদশ শতকে ক্রুসেড বাহিনীর সঙ্গে আইয়ুবিদের অনেক যুদ্ধ এখানে সংঘটিত হয়।

১১৮৭ সনে ঐতিহাসিক হিট্টিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই অঞ্চলেই। যাতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবির নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন। হিট্টিন তৎকালীন সময়ে সিনাইয়ের অংশ হলেও বর্তমানে ফিলিস্তিনের অন্তর্গত। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত আইন জালুতের যুদ্ধের স্থানও এই সিনাই উপদ্বীপ। এই অঞ্চলটিও বর্তমানে ফিলিস্তিনের অন্তর্গত। যুদ্ধটি মিশরের মামলুকি শাসনামলে মামলুকি ও তাতারিদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিলো।

এভাবে প্রতিটি যুগেই সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতো এই সিনাই উপদ্বীপের দিকে। এখানে অধিকার বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়। আধুনিক কালের অন্যতম যুদ্ধ হলো মিশর-ইসরাইল যুদ্ধ। ১৯৬৭ সালে সুয়েজখাল পর্যন্ত গোটা সিনাই অঞ্চলই ইসরাইল ছিনিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মিশর তা পুনরুদ্ধার করে।

সিনাই উপদ্বীপের বুক চিরে খনন করা সুয়েজ খাল বিশ্বের দীর্ঘতম খাল হিসেবে পরিচিত। যা ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশকে পৃথক করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গোটা বিশ্ব জুড়ে এই খালটি অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে আছে।    

কায়রো থেকে এই শহরটি দূরত্ব ৪৩০ কিলোমিটার। তবে সরাসরি পথে না গিয়ে শারম আশ-শায়খ শহর দিয়ে ঘুরে গেলে এর দূরত্ব বেড়ে হবে ৭৪০ কিলোমিটার। সরাসরি পথটি নানা সময়ে নানা কারণে বন্ধ থাকে। তখন দ্বিতীয় পথটি অবলম্বন করতে হয়। এ পথের দৈর্ঘ্য একটু বেশি হলেও তূরে সিনায় যাতায়েতের জন্য এটিই অধিক নিরাপদ। ঘন ঘন চেকপোস্ট থাকায় একটু ঝামেলায়ও পড়তে হয়। তবে নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ের কথা মাথায় রেখে আমরা এই পথেই রওয়ানা হই।

পথিমধ্যে আমরা ‘উয়ুনে মূসা বা মূসা (আ.) এর ঝর্না’ বলে খ্যাত জায়গাটিতে অবতরণ করি। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মূসা (আ.) এর বারটি ঝর্না, যা তার নিজ সম্প্রদায়ের জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে লাঠি দিয়ে আঘাত করার ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো। এটি দক্ষিণ সিনাই উপদ্বীপের সুইস অঞ্চলে অবস্থিত। জায়গাটি এখন মিশরের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। নিয়মিতই পর্যটকরা আসেন ঝর্নার জায়গাটি দর্শনে। কিন্তু বর্তমানে আমরা ঝর্না বলতে যা বুঝি, অর্থাৎ পাহাড় কিংবা কোনো উঁচু ভূমি থেকে পানির অবতরণ, তেমন কিছু নেই এখানে। তবে কয়েকটা কূপের মতো দেখতে পেলাম। সম্ভবত ঝর্না বলতে এই কূপগুলোকে বোঝানো হয়েছে।

কূপগুলোর আকার-আয়তন স্বাভাবিক অন্যান্য কূপের তুলনায় অনেক বেশি। ভেতরে পানির কোনো চিহ্ন নেই। তবে একটি কূপের একেবারে তলায় সামান্য পানি দেখা গেলো। অনেকগুলো বালুতে ভরাট হয়ে গেছে। কয়েকটা পর পর একসঙ্গে আবার কয়েকটা বেশ দূরে। পর্যটকদের সুবিধার্থে বালুর উপর পাথর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটা কূপের পাশে নামফলকে এগুলোর নাম ও গভীরতা উল্লেখ আছে। নামগুলো বেশ চমৎকার- যেমন বিরুয যাহরা, বিরুল বাহরি, বিরুল গরবি, বিরুশ শায়েব, বিরুশ শায়খ, বিরুস সাক্বিয়া ও বিরুল বাক্ববাক্বা। কূপগুলোর গড় গভীরতা ৪০ বর্গফুট। বর্তমানে কূপগুলোর সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে।

এখানে ঘোরাঘুরি শেষে আমরা সরাসরি তূর পর্বতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। তখন বেলা এগারোটা। মাঝ আকাশে সূর্য। শীতের তীব্রতা আর নেই। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আবার কুয়াশা আবৃত হয়ে পড়বে জনপদ, লোকালয়। আমাদেরকে এর পূর্বেই পৌঁছতে হবে। এজন্য গাড়ি ছুটে চললো দুরন্তবেগে। পথের পর পথ মাড়িয়ে চললো অবিরাম। পথের দু’পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। পাথুরে পাহাড়। পাথরগুলো বেশ বড় বড়। মনে হচ্ছিলো বাতাসের প্রবল ঝটকাতে নিচে গড়িয়ে পড়বে। তখন আশপাশের সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দেবে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম।

দু’পাশে পাহাড় হওয়ায় মাঝখানে গিরিপথের মতো রাস্তা। আঁকাবাঁকা আর উঁচু নিচু। একবার মনে হবে এই বুঝি আকাশের দিকে বেয়ে উঠছি, কিছুক্ষণ পর আবার মনে হবে নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। তখন গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। শিহরিত হয় গোটা শরীর, কিন্তু মনের ভেতর আনন্দের ঢেউ উতলে উঠে। এই যে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা! এক নতুন দুঃসাহসিকতা!

কখনও চলতে চলতে পাহাড়ের সীমানা শেষ হলে শুরু হয় মরুপ্রান্তর। ধু ধু বিস্তৃর্ণ মরুভূমি, রোদেলা দুপুরে তার বালিগুলো চিক চিক করছে। শীতকালে মরুঝড়ের সম্ভবনা নেই, মরুভূমি তাই সুবোধ বালকের ন্যায় শান্ত। দিগন্ত বিস্তৃত এই মরুতে কোনো মরুচারী ছুটে চললো বুঝি আপন গন্তব্যে! তবে একবার পথ হারালে পুনরায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। আকাশের নীলিমা গিয়ে মিশেছে দিগন্তের শেষ প্রান্তে। এই বুঝি কিছুদূর হাঁটলে স্পর্শ করা যাবে আকাশ! কিন্তু এই প্রচেষ্টা হবে মরীচিকার পেছনে দৌড়ানোর মতো। কোনো সফলতা আসবে না। মাইলের পর মাইল যাবে, মাথার উপর আকাশও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলবে। তখন না পাবো আকাশ ছুঁতে, না দেখবো কিনারাহীন মরুর প্রান্তশেষ।

এভাবে একপর্যায় মাঝ আকাশ থেকে সূর্য হেলে পড়ে ডানদিকে। বিকেলের শুভসূচনা হয়। পৃথিবী রাতের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটু পথ এগুতেই মনে হয় অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এই বুঝি সাঁঝ সাঁঝ রব শুরু হলো! আঁধার ঘনিয়ে কালো রাত হলো! লুকিয়ে গেলো আশপাশের নয়নাভিরাম সব সৌন্দর্য! হারালো কোনো অচিনপুরের দেশে! আমি বিগলিত হৃদয়ে শেষবারের মতো সব দেখে নিচ্ছিলাম।

সন্ধ্যা নাগাদ আমরা তূর পর্বতের সীমানায় পৌঁছে গেলাম। এখানে আসার পর চোখে পড়লো হযরত হারুন (আ.) এক কবর। রাস্তার একপাশে নামফলকে লেখা ‘মাক্বামুন নাবী হারুন’। এই দেখে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, নবী মূসা আর হারুন (আ.) ছিলেন সহোদর ভাই। মূসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তূর পর্বতে গেলেন, আর তার স্থলাভিষিক্ত হলেন আপন ভাই হারুন। তিনি এসে দেখেন লোকেরা গোবৎসের পূজা শুরু করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার দাড়ি ধরে দিলেন এক চড়। হারুন (আ.) মিনতি করে তাকে দাড়ি ধরতে নিষেধ করলেন। সে কি চমৎকার ইতিহাস! কবরটি দেখে মনে হলো জীবন্ত একটি ইতিহাস দেখছি। আমরা বাস থেকে নেমে এখানে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি করলাম। পবিত্র কবরটি যেয়ারত করলাম।

কিছুদূর যাওয়ার পর সেই ঐতিহাসিক চিত্রটি দেখতে পেলাম। গোবৎসের স্রষ্টা সামেরি আর তার আহ্বানে সাড়া দেওয়া লোকগুলোর চিত্র। সঙ্গে গোবৎসটিও আঁকা। বিশাল এক পাহাড়ের গায়ে পাথর খোদাই করে খুব শৈল্পিকভাবে এ কাজটি করা হয়েছে। যে কেউ প্রথম দেখাতে মনে করবে, এটা চিত্র নয় কোনো জীবন্ত লোকালয়ের দৃশ্য। গোবৎসটির চিত্র অনেকখানি জায়গাজুড়ে। তার চারপাশে লোকজন। লোকগুলো গোবৎসটির পূজা করছে এজাতীয় একটা ভাব। শত সহস্র বছর পূর্বেকার একটি ইতিহাসকে জীবন্ত রূপ দেয়ার চেষ্টা। আমরা এখানেও বিরতি নিলাম প্রায় ঘণ্টা খানেক। শেষ দিকে কিছু চোখে পড়ছিলো না। আঁধারে ছেয়ে যায় সবকিছু। এখান থেকে যখন প্রস্থান করলাম, তখন মনে অপূর্ণতার একটা রেশ রয়ে যায়।

পাশের এক মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে তূর পর্বতের পানে ছুটলাম। তখন প্রকৃতিতে অজানা এক শব্দ শুনতে পেলাম। কিসের যেনো হইচই পড়ে যাওয়ার মতো শব্দ। এই শব্দ আর কিছু নয়, তূর পর্বতের ধ্বনি। পর্বতটি তার নিকট আগত অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে। সে হইচই করে সুস্বাগতম বলছে। পরিবেশের নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আজই তার বুকে পদাচারণা করবে একদল পথিক, যারা সুদূর বাংলাদেশ থেকে আগত। তারা জীবনের রঙিন দিনগুলোকে আরো রাঙাতে চাচ্ছে ইতিহাস বিখ্যাত একটি পর্বতারোহনের মধ্য দিয়ে। জীবনের সুপ্ত বাসনাগুলোর মাঝে যে আশা ক্ষীণ প্রদীপে মিটমিট করে জ্বলছিলো এতদিন, সেটা আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে। জীবনে আজ নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হবে। তূর পর্বত জয়। এই জয়ে যৌবন ছুটবে আরো বহুদূর।

আমরা তূর পর্বতের পাদদেশে একটি হোটেলে উঠলাম। এখানে রাত বারোটা পর্যন্ত বিশ্রাম হবে। তারপর পর্বতে আরোহণের পালা। মিশরবাসীদের নিকট এই তূর পর্বত ‘জাবালে মূসা’ নামে অধিক পরিচিত। পর্বতটির উচ্চতা দুই হাজার দুইশ ৮৫ কিলোমিটার। এটি উচ্চতার দিক থেকে মিশরের ক্যাথেরিন পর্বতের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ক্যাথেরিন পর্বতের উচ্চতা দুই হাজার ছয়শ ৩৭ কিলোমিটার, এটি ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। পর্বতের উপরে উঠার জন্য দুটি পথ আছে। প্রথম পথটি শিকেত আল বাশাইত হিসেবে পরিচিত। এটি অনেক লম্বা এবং খাড়া হয়ে উঠেছে। পায়ে হেঁটে অথবা স্থায়ী বেদুইনদের উটের সাহায্যে উঠা যায়। দ্বিতীয় পথটি শিকেত আস-সাইদনা মূসা হিসেবে পরিচিত। এটি আশ্রমের পেছন দিয়ে যায়। এই রাস্তাটি প্রায় তিন হাজার সাতশ ৫০ মিটার লম্বা।

আমরা দ্বিতীয় পথটি ধরেই হাঁটতে শুরু করলাম। অধিকাংশ হেঁটেই উঠেন, এক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধদের উট নিয়ে উপরে উঠতে দেখা যায়। আমরা সঙ্গে একজন গাইড নিয়েছিলাম। এরা দেখিয়ে দেখিয়ে সুবিধা মতো জায়গা দিয়ে উপরে নিয়ে চলেন। এটাই এদের কাজ। একসঙ্গে অনেকগুলো পাহাড় বলে গাইড ছাড়া উঠা যায় না। অন্যথায় পর্বতের ঘোরপাকেই জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে পড়বে। তূর পর্বত আর দেখা হবে না।

এই পথটি সমান্তরালভাবে উপরে উঠেছে, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর থেকে ডানে বামে বাঁক নেয়। অন্ধকার বলে টর্চ লাইটের সাহায্যে উঠছিলাম। গাইড পাথর দেখে বুঝে শুনে পথ এগুচ্ছিলেন। আমরা তার অনুসরণ করছি। কিছুক্ষণ পর পর ছোট ছোট দোকান-পাটের মতো আছে। এগুলোতে চাসহ হালকা নাস্তা সেরে একটু বিশ্রাম নেয়া যায়। তাতে বেশ সুবিধা হয়। কিছুদূর উঠার পর যে ক্লান্তি ভর করে, তা এই দোকানগুলোতে ক্ষণিকের বিশ্রামে কেটে যায়।

শীতের মৌসুম হওয়ার কারণে কায়রো থেকে যে দুশ্চিন্তা মাথা নিয়ে এসেছিলাম, এখানে প্রচণ্ড শৈতপ্রবাহের। তা ঠিকই ছিলো তবে পর্বতারোহণের ফলে শীত লাগছিলো না তেমন। বরং গায়ের ভারি ভারি পোশাকগুলো খুলে ফেলতে হলো। তাতে যে সহায়তাটুকু হলো, শরীর হালকা হওয়ায় আমরা আরো দ্রুতবেগে উপরে উঠতে লাগলাম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক উঠার পর উটের রাস্তা শেষ হয়। মানে উটগুলো আর এর উপরে উঠতে পারে না। এখান থেকে রাস্তাটি একটু খাড়া প্রকৃতির। উঠতে হয় সাবধানে। প্রস্তরাকীর্ণ বলে পা ফেলতে অনেক অসুবিধে হচ্ছিলো। গাইড খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে চলতে লাগলেন।

আমরা আরো অনেক উপরে উঠে এলাম। এখান থেকেই শুরু জাবালে মূসার। এতক্ষণ এগুলো ছিলো এরসঙ্গে লাগোয়া পাহাড়। জাবালে মূসা এই পাহাড়গুলোর মাঝখানে। নিচ থেকে তাই অনুমান করা যায় না কোনটা। এখান থেকে উপরে অর্থাৎ পর্বতের শীর্ষে উঠতে হবে একেবারে খাড়া পথ দিয়ে। তবে ভরসা এইটুকু, পাথর কেটে কেটে সিঁড়ির মতো করা আছে, তবে ঠিক সিঁড়ি বলা যায় না। একটু পা পিছলালে সবশেষ। তাই উঠতে হবে আরো অধিক সতর্কতার সঙ্গে।

এখানে বইছিলো প্রবলবেগে ঠাণ্ডা বাতাস। দাঁড়িয়ে থাকাটাও দায় হচ্ছিলো, চূড়ায় উঠাতো দূরে থাক। অনেকে পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলো। আবার কেউ কেউ নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে চাচ্ছিলো। আমি সাহস সঞ্চয় করে উপরে উঠতে উদ্যত হলাম। এতদিনের লালিত স্বপ্নকে যে করেই হোক বাস্তাবায়ন করতে হবে। স্বপ্ন যে সংকল্পে রূপ নিয়েছে! আর সংকল্প বাধ মানে না কখনও, যেকোনো প্রকারেই তা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবেই। আমি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তৎপর হয়ে উঠলাম। বুকে হিমালয় জয়ের মতো সাহসের সঞ্চয় করলাম। আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হলাম, আমিই পারবো। দুনিয়ার কোনো বাধা আমাকে রুখতে পারবে না। আসুক যতো বাধার প্রাচীর আজ ডিঙাবোই সব।

আমি এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। আরো কয়েকজনও আমাকে সঙ্গ দিলো। এদিকে বাতাসের তীব্রতা মনে হচ্ছিলো আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। যত উপরে উঠছি, বাতাসের বেগ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখান থেকে অনুমান করলাম, পৃথিবীতে বাতাসের জোর কতো হতে পারে? আর আকাশের বিশালকায় মেঘমালাকে কী করে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে চলে?

খেজুর নাকি খুব শক্তিবর্ধক ফল। সঙ্গে তাই অনেক খেজুর নিয়ে এসেছিলাম। মরুর দেশে এই খেজুর অন্যতম খাবার হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। উঠতে উঠতে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম, তখন দু’একটা খেজুর মুখে দিয়ে চিবানোর চেষ্টা করলাম। তারপর আবার উঠা। প্রায় দেড় ঘণ্টা উঠার পর আমরা পর্বতের চূড়ায় আরোহন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। এই নিয়ে মোট সময় ব্যয় হলো সাড়ে তিনঘণ্টা।

এই সময় ফজরের আযান হলো। সেই সঙ্গে রাতের অন্ধকারও দূর হলো। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের রক্তিম আভা পসরা মেলবে আর কিছুক্ষণ পরই। তখন একটি সোনালি দিনের শুভ সূচনা হবে। যে দিনের শুরুতেই আমরা আছি তূর পর্বতের চূড়ায়। পৃথিবীকে দেখছি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিকে। মনে হচ্ছে সমতল নয় পৃথিবী। সর্বত্রই তার উঁচু নিচু। যেখানে আছে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, পর্বত আর পর্বত, আর এই পর্বতরাজি আকাশে মেঘের বিচরণকে বাধা দিচ্ছে।

আমরা দেখলাম এখানে একটি মসজিদ আর একটি গির্জা পাশাপাশি অবস্থান করছে। মুসলমান ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট পর্বতটির সমান গুরুত্ব থাকায় এই পদক্ষেপ। চূড়ার আয়তন অনেক কম বলে মসজিদ আর গির্জাও খুব ছোট করে নির্মাণ করা হয়েছে। চূড়ায় একসঙ্গে একশোর বেশি মানুষের সংকুলান হবে না। সবাইকে তাই একটু গাদাগাদি করে থাকতে হয়।

পর্বতশৃঙ্গ থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। দেখে মনে হবে সূর্য বুঝি পর্বতের পাদদেশ থেকে উদিত হচ্ছে। আমরা এর থেকে অনেক উপরে অবস্থান করছি। হাতের ইশারায় সূর্যকে স্পর্শ করা যায়। তবে বেশিক্ষণ এই দৃশ্য থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তেজও পালাক্রমে বাড়তে থাকে। উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে কেমন ভয় ভয় করে উঠে। এই বুঝি পড়ে গেলাম, এ জাতীয় একটা ভাব আসে মনে।

চূড়ায় বইছিলো প্রবলবেগে ঠাণ্ডা বাতাস। এখানকার বাতাসের জোর সর্বাপেক্ষা বেশি। গায়ের জামা-কাপড়সহ আমাদের উড়িয়ে যাচ্ছিলো। দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় দায় হচ্ছিলো। কোনো কিছু বলার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যাকে বলছি সে কিছু শুনতে পায়না। উচ্চস্বরে ডাক দিলে মনে হবে বুঝি নিজের সঙ্গে কথা বলছি। এ এক বিস্ময়কর দৃশ্য। এ দৃশ্যে আমরা আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। নিচে নেমে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। বেলা যে অনেক গড়ালো।

এবার ফেরার পালা। ফিরতে হবে আপন আপন বসতিতে। নিজ নিজ কর্মস্থলে। প্রবাসের জীবন যাত্রায় অতিষ্ঠ মানুষগুলোর একসঙ্গে কিছু সময় কাটানোর এইটুকুই সুখস্মৃতি। এই স্মৃতি ধারণ করে রাখতে হবে অনেকদিন। যতদিন না আবার অন্য কোনো জায়গায় আমরা মিলিত হচ্ছি। কোনো আশ্চর্য পৃথিবী দেখার বাসনায়।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!