কিন্তু পরিবেশ এখনও নীরব নিস্তব্দ। জনমানুষের নিত্যনৈমিত্তিক কোলাহল আরম্ভ হতে খানিক বাকি। আমরা অযু-গোসল শেষে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। আজকের গন্তব্য ঐতিহাসিক আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি।
সবাই যার যার মতো প্রস্তুত হলাম। আমাদের ট্রাভেল গাইড আদেল ঘোষণা দিলেন, আর দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে যাবে। আমরা বিলম্ব না করে গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়ি ছুটে চলল সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউগুলো আমাদের সামনে এসে আবার হারিয়ে যেতে থাকল। আধ ঘণ্টা একাধারে গাড়ি চলার পর আমরা লাইব্রেরির সামনে এসে হাজির হলাম।
বাহির থেকেই এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দর্শকদের অতি আকৃষ্ট করে। এর বিশালকায় গায়ে খোদাই করা বিশ্বের বিদ্যমান কিংবা বিলুপ্তপ্রায় সব ভাষার বর্ণমালাগুলো। আমরা অনেক কষ্টে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার বর্ণমালাগুলো খুঁজে বের করলাম। আমাদের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বন্ধুরা থাকায় প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ভাষার বর্ণমালাগুলো খুঁজে বের করতে তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ কেউ খুঁজে পেলো না।
যাক, হয়ত ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। সহস্র বছর পেরিয়ে আসা বিশ্বের বুকে ভাষার জন্ম তো কম হয়নি, কাজেই খুঁজে না পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এখানে লাইব্রেরিটির পাশেই রয়েছে একটি থিয়েটার ভবন। একটি ঐতিহাসিক যাদুঘর ও কনফারেন্স হল। তবে সবকিছুর আগে আমরা লাইব্রেরির ভেতরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। ইতিহাস সূত্রে লাইব্রেরিটি সম্পর্কে যা জানা যায়- খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বাতলামিউস এর শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়। গ্রন্থাগারটি তখন ‘আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগার বা আলেকজান্দ্রিয়ার রাজ-গ্রন্থাগার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলোর একটি।
গ্রন্থাগার ছাড়াও মিউজিয়ামে ছিল জ্যোতির্বিদ্যা ও পঠনপাঠনের কক্ষ এবং দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের একটি চিড়িয়াখানা। যেসব বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এই গ্রন্থাগারে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে গণিত, প্রযুক্তিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, ভূগোল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশিষ্ট প্রথীতযশা মণীষীরা আছেন। এরা হলেন ইউক্রিড, আর্কিমিডিস, এরাটোস্থেনিস, হেরোফিলাস, এরাসিস্ট্রাটাস, হিপ্পারাকাস, এডেসিয়া, পাপ্পাস, থেওন, হাইপেশিয়া, আরিস্টারকাস অব সামোস ও সেন্ট ক্যাথারিন।
এই গ্রন্থাগার ছিল মিশরের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক। সারা পৃথিবী থেকে বই ধার করে তার অনুলিপি তৈরি করা ও সেই বই গ্রন্থাগারে নিয়ে আসার জন্য এই গ্রন্থাগারে কর্মচারী নিয়োগ করা হতো। অধিকাংশ বই রাখা হয় প্যাপিরাস স্ক্রোলের আকারে। তবে ঠিক কতোগুলো স্ক্রোল এই গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল তা জানা যায় না। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর থেকে অবশ্য কোডেক্সও ব্যবহৃত হয়ে গেছে।
এই গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। যার ফলে বহু স্ক্রোল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের অগ্নিকাণ্ড তাই সাংস্কৃতিক জ্ঞান ধ্বংসের প্রতীক। প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে এই অগ্নিকাণ্ডের সময় নিয়ে মতভেদ পাওয়া যায়। কে এই অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছিলেন তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। এই ধ্বংস নিয়ে একটি জনশ্রুতি হলো, বহু বছর ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে এই গ্রন্থাগার বিনষ্ট হয়। সম্ভবত ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময়, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময়, ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে এবং ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মিশরে মুসলমানদের আক্রমণের ফলে সংঘটিত পৃথক পৃথক অগ্নিকাণ্ডে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়।
উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ লাইব্রেরি এক দৃষ্টিতেই দেখা যায়। আধুনিক সব প্রকার প্রযুক্তিই এতে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে এখানে আগত যে কোনো দর্শককেই চোখের পলকে তা আকৃষ্ট করে। আমরা লাইব্রেরির সবদিকেই দীর্ঘক্ষণ বিচরণ করলাম। দু-একটা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখলাম। অনেকে লাইব্রেরির বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তুলে নিলো। বেলা একটায় যখন ফিরে আসার সময় হলো, তখন মন যেন আসতে চাচ্ছিল না।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |