কায়রোর চিঠি: ঐতিহ্যের লীলাভূমি আলেকজান্দ্রিয়া

দিনটি ছিলো সোমবার। স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো। মনে মনে তাই অনেক আনন্দ। তাছাড়া এখন থেকে শুরু হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন দীর্ঘ চার মাসের ছুটি। এই ভেবে আরও প্রফুল্ল হলাম।

মোহাম্মাদ আবু জাবের, মিশরের কায়রো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2018, 11:13 AM
Updated : 1 Sept 2018, 11:34 AM

তবে এই দীর্ঘ ছুটিতে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে যেতে পারছিনা বলে আবার হতাশায়ও ডুবে গেলাম। মনের সব আনন্দ সঙ্গে সঙ্গে নিরানন্দে পরিণত হলো। কারণ, দেশে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি দেবে দ্বিতীয় বর্ষের পর। কাজেই আরো একটি বছরের প্রতীক্ষা। মা আর মাতৃভূমিকে দেখতে হলে এই একটি বছরের প্রতীক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

প্রবাসের জীবন মানেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকা, একটি সোনালি সকালের জন্য। যেদিন নিজ ভূমিতে ফিরে আপন পরিবার পরিজন নিয়ে হাসি-আনন্দে দিনগুলো অতিবাহিত হবে। আর সোনালি সকালের সেইদিন পুব আকাশের রক্তিম সূর্যরশ্মিতে এক অপূর্ব ঝিলিক ছেয়ে যাবে।

অনেক ভেবেচিন্তে ছুটি কাটানোর জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েকদিনের ভেতর প্রবাসী ছাত্রাবাস থেকে আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা কয়কজন স্বদেশি বন্ধু এই ভ্রমণে নাম নিবন্ধন করলাম। গ্রীষ্মের ছুটিতে আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণ মন্দ হবে না। বরং হতাশার কালো মেঘ তাতে একটু হলেও কাটবে।

আলেকজান্দ্রিয়া নগরী, ইতিহাস খ্যাত এক শহর। শত শহস্র বছরের অসংখ্য ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এ নগরী, বুকে তার অজস্র স্মৃতি। প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার প্রতিকৃতি এ নগরীটি মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি মিশরের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। ভূমধ্যসাগর উপকূলে এটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। মিশরের প্রধান সমুদ্র বন্দর এখানেই। দেশের আমদানি রপ্তানির শতকরা ৮০ ভাগ এখান থেকেই হয়।

আমরা প্রবাসী ছাত্রদের সঙ্গে ভ্রমণে নাম নিবন্ধন করলেও একসঙ্গে যেতে পারলাম না। আমি আর আমার এক স্বদেশি বন্ধু। কাজেই বিকল্প পথ নিয়ে ভাবতে হলো। এখান থেকে আলেকজান্দ্রিয়া গমনাগমনের জন্য সচরার পাওয়া যায় ট্রেন। এছাড়া রয়েছে উন্নতমানের বাস। নদী নেই বলে লঞ্চ বা স্টিমারে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমরা ট্রেনেই চড়ে বসলাম। বাসে উঠলাম না, কারণ তাতে গুনতে হবে কড়ি কড়ি টাকা। বুঝতেই তো পারছেন, ছাত্র মানুষ। কাজেই চিৎকার-চেচামেচি আর হৈ-হুল্লোড় কিছুটা শুনতে হবে সেটা আগ থেকেই মনে গেঁথে নিলাম।

তবে এতটা যে হবে, সেটা বুঝলাম ট্রেনে উঠার পর। মনে হলো যেন সদ্য বসা একটি মাছের বাজার। হকার, ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে সবই আছে এখানে। কিন্তু ট্রেন ভ্রমণ আরামদায়ক হয় বলে মনে মনে আনন্দ অনুভব করলাম। সিট পড়েছিল জানালার পাশে। তাই আরেকটু স্বস্তি। দীর্ঘ যাত্রার ভ্রমণ। পড়ন্ত বিকেলে টকটকে লাল সূর্যকে পেছনে ফেলে ট্রেন চলতে শুরু করল। গোধূলির হিম শীতল বাতাস দেহ মনে ভালই লাগছিল। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। পশ্চিম দিগন্তের সূর্যটাকে তখনও রক্তিম দেখাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরই ঘন কালো আঁধারে ছেয়ে যাবে সবকিছু। প্রকৃতিতে নেমে আসবে নীরবতা, নিস্তব্ধতা। খানিক বাদে মাগরিবের আযান হল। আমরা অযু সেরে নামায আদায় করলাম। ট্রেন চলছিল বাতাসের বেগে। সেই সঙ্গে সময়ও গড়াচ্ছিল অকাতরে। আস্তে আস্তে রাত হলো। কমে এলো মানুষের শব্দ, কোলাহল। সর্বত্র বিরাজ করল পিনপতন নীরবতা। পাশের সিটে একজন উচ্চস্বরে নাক ডাকছিল। নিভৃত পরিবেশে তার নাকের আওয়াজ লাগছিল বড়ই কর্কশ। আমাদের দুজনার গল্প-গুজবেও দিচ্ছিল বাধা। ফলে ব্যাপারটি আর সহ্য হচ্ছিল না মোটেও। মন চাচ্ছিল লোকটাকে একদিকে ঠেলে দিতে। শুনেছি চিত হয়ে ঘুমালে নাকি মানুষ নাক ডাকে বেশি। তখন একপাশে করে দিলে নাক ডাকা বন্ধ হয়। তাকে এমন করে দিতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু জেগে উঠার ভয়ে তা আর করলাম না।

আবার অদূরে কান্না করছিল একটি শিশু। তার মা নানা অভিনয় করেও কান্না থামাতে পারছিল না। শেষে দিলো এক ধমক। শিশুটির কান্না বাড়ল আরও কয়েকগুন। এবার ধপাস করে সিটের নিচে ফেলে দিলো। শিশুটি আরও হাউমাউ করে চিৎকার শুরু করল। আমি কাছে গিয়ে আঞ্চলিক আরবিতে বললাম- ‘কী হলো বাপু? কী চাও?’ সে কোনো উত্তর দিলো না। মনে হয় আমার উচ্চারণটি ঠিকমত হয়নি কিংবা এখনও সে পুরোপুরি কথা বলা শেখেনি। বয়স দেখে তাই মনে হলো। আমি পকেট থেকে একটি চকলেট বের করে হাতে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ। চকলেটে শিশুরা কী পায় তা মনে হয় মনোবিজ্ঞানীদের কাজ। আমি আর এ নিয়ে কোনো গবেষণায় যেতে চাই না। তবে সেই ছোটবেলা থেকেই একটি জিনিস দেখে আসছি, চকলেটের প্রতি শিশুদের টান। নিশ্চয় এরমধ্যে থাকতে পারে কোনো রহস্য। মহিলা আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানাল। আমিও ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলাম।

কিছুক্ষণ পর দুনিয়াজুড়ে ছেয়ে গেলো আঁধার। ট্রেনের ভেতর টিমটিম বাতি জ্বলছে। এতে কেবল চেহারাগুলো সামান্য বোঝা যাচ্ছে। কারও কোনো সাড়া শব্দ নেই। আমরা দুজন গল্পে মেতে উঠলাম। ছোট্ট জীবনে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো হাতড়ালাম। সেই সঙ্গে কখনও একটু হাসি আবার কখনও একটু বেদনাভাব। কি বিচিত্র মানুষের মন! একই সঙ্গে হাসি আর কান্না! বস্তুত, মানুষের জীবনটা এমনি। যখন কোনো স্থানে নির্জনে বাস করে তখন একে একে তার সামনে ভেসে উঠে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। অতীত জীবনের স্মৃতি।

তবে দুঃখ-গাঁথা বাদ দিয়ে হাসি জাগানিয়া গল্পে মন দিলাম। তাতে গল্প বেশ ভালই জমে উঠল। ঠিক তখন ঘটে গেলো এক মর্মস্পর্শী ঘটনা। কয়েকটি ছোট ছোট শিশু খেলছিল রেললাইনের উপর। আচমকা ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই দৌড়ে পালালেও একজন রয়ে গেলো। সে দৌড়ালো ধীরগতিতে। যা হবার তাই হলো। মনে দুঃখ নিয়ে গভীর রাতে আমরা আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছলাম।

রাত তখন ঠিক দুটা। আমাদের কয়েকজন বন্ধু এখানে আগে থেকেই ছিলেন। তারাও কায়রোর প্রবাসী ছাত্রাবাস ‘মাদিনাতুল বুউস’ থেকে গ্রীষ্মের ছুটিতে সাতদিনের ভ্রমণে এখানে এসেছেন। আমরা দুজন পরে এসে আজ এ কাফেলার সঙ্গে যুক্ত হলাম। ফলে রান্না-বান্না, শোবার জায়গাসহ সবকিছু আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এ নিস্তব্দ রজনীতে আমাদের আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হলো না। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম।

খাবার মাঝে চলছিল দীর্ঘ ভ্রমণের গল্প। বিশেষ করে শিশুটির দুর্ঘটনার কথায় সবাই আপ্লুত হয়ে পড়লো। বেঁকে বসলেন শুধু যুবায়ের ভাই। তার এটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এমনিতে যেকোন ধরনের গল্প তিনি বিচার-বিবেচনা না করে বিশ্বাস করেন না। প্রমান দেওয়ার মতো কোনো কিছু ছিল না, তাকে বোঝাতে একটু কষ্ট হলো। অন্যদিকে গল্পটি বলার সময় সালমান একই রকম আরেকটি গল্প বলে ফেললো, সেটিও ছিল খুব মর্মান্তিক।

আলেকজান্দ্রিয়ায় আমরা যে জায়গায় এসে উঠলাম, এর নাম এখানকার স্থানীয় ভাষায় ‘মাদিনাতুল বুউস আল ইসলামিয়া’। ইংরেজিতে যাকে ‘ইসলামিক মিশনস সিটি’ বলা হয়। এটি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির রাস্তা ধরে মুন্তাজা গার্ডেনের একটু আগে। এ রাস্তাটি সরাসরি ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। ফলে ক্যাম্পাস থেকে সাগরের দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত। এটি আযহার ইউনিভার্সিটির বিদেশি ছাত্রদের অন্য একটি ক্যাম্পাস। প্রধান ক্যাম্পাসটি রাজধানী কায়রোতে অবস্থিত যেখানে আমরা বসবাস করি।

এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, ‘আযহার’ ব্যাপক অর্থে একটা বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের নাম। আরবিতে ‘আল-আযহার আশ-শরিফ’ লেখা হয়। এর অধীনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে বিশ্ববাসী ‘আযহার বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে জানে। আরও আছে স্কুল, কলেজ, অসংখ্য মসজিদ, আন্তর্জাতিক দাওয়াহ বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইমাম প্রশিক্ষণ বিভাগ ইত্যাদি। মিশরসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাসী ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত কায়রোর ক্যাম্পাসেই থাকেন। আলেকজান্দ্রিয়া ক্যাম্পাসে আযহারের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই সুবাদে আমাদেরও দীর্ঘ ছয়-সাত মাস থাকার সুযোগ হয়েছিল।

এ হিসেবে এখানকার পথঘাটগুলোর সঙ্গে আমি আগে থেকেই বেশ পরিচিত ছিলাম। বিশেষ করে এখানে পড়াকালীন সময়টা খুব উপভোগ করতাম। বিকেলে বইতো সাগরের মৃদু বাতাস। দেহমনে খুব সহজেই আনন্দের দোলা দিয়ে যেতো। সাগরের তীর দিয়ে একাকী আপন মনে চলার মজাই ছিল আলাদা। যে কোনো সুখ-দুঃখ সহজেই সাগরের সঙ্গে ভাগাভাগি করা যেতো। মরুভূমির লু-হাওয়া যখন গোটা মিশরবাসীকে তাতিয়ে তুলতো, তখন এখানে বইতো ঠাণ্ডা হিমশীতল বাতাস। বলতেই হয়, গ্রীষ্মের মৌসুমে প্রকৃতির এই রূপ আলেকজান্দ্রিয়াবাসীর জন্য স্রষ্টার এক অপার দান।

প্রচণ্ড খরতাপের সময় আমরা দেখতাম, কীভাবে দলে দলে মিশরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ দিশেহারা হয়ে এখানে ছুটে আসছে। যাতে ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে রয়েছে বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা। এসেই সাগরের পানিতে দেহটিকে নিস্তেজ প্রাণীর মতো ভাসিয়ে রাখত। সাঁতার কাটত, আবার কেউ হাবুডুবু খেতো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নানা ধরনের খেলাধুলা করতো। এখানে অধিকাংশ মানুষ ছুটে আসে দলবদ্ধ হয়ে, কিংবা পরিবারের সঙ্গে। দূরবর্তী শহর বলে এখানে খুব কম লোকই একা ভ্রমণ করেন। মিশরের এ সাগরটির নাম ভূমধ্যসাগর।

সাগরটি দেখতে পরদিন সকালে আমরাও দলবদ্ধ হয়ে ছুটে গেলাম। আমাদের ট্রাভেল গাইড ছিলেন আদেল। খুব হাসি-খুশি প্রকৃতির একজন মানুষ। কখনো কারো সঙ্গে মন্দ ব্যবহার তো দূরে থাক কটুকথাও বলেন না। বয়সে প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। এখনো যে হারে তিনি বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়ান তাতে পৌঢ়ত্বের কোনো আলামতই তার মাঝে ফুটে উঠে না। ভ্রমণপ্রিয় ছাত্রদের কাছে তিনি অতি পরিচিত এক নাম, মাদিনাতুল বুউসের সব ছাত্রই এক বাক্যে ওস্তাদ আদেলকে চেনেন। তিনি আমাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে ক্যাম্পাসের কাছে একটি সৈকতে নিয়ে গেলেন।

টিকিটের টাকা আমাদের কাউকে দিতে হলো না। সাধারণত ছাত্রবাস কর্তৃপক্ষের আয়োজনে কোথাও ভ্রমণে গেলে সেখানকার প্রসিদ্ধ স্পটগুলোর টিকিটের টাকা কর্তৃপক্ষই বহন করে থাকে। তাই আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমরা বিচে প্রবেশ করে যে যার মতো সাগরে বিনোদন করলাম। ঘণ্টা চারেক অবস্থানের পর আবার ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। এখানে সপ্তাহব্যাপী এসব ভ্রমণে নানা আয়োজন থাকে। থাকে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, খেলাধুলা, চিত্ত-বিনোদন, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। সে হিসেবে আজ আমাদের প্রথমদিন ছিলো সাগর ঘোরাঘুরি। বিকেলে চলছিল খেলাধুলা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রী এখানে আছে বলে খেলাধুলার প্রকারও রকমারি হয়। ফুটবল, হকি, ভলিবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, টেবিল টেনিস ইত্যাদি প্রায় নিয়মিতই দেখা যায়।

এভাবে সন্ধ্যা শেষে রাত হলো। রাত পেরিয়ে হলো সকাল। সকাল সাড়ে আটটা। সূর্যের উঁকিঝুঁকি রশ্মিতে আমরা চোখের পাতা মেললাম। মৃদু বাতাস তখন দেহমনে শীতলতার স্নিগ্ধ হিল্লোল বইয়ে দিচ্ছিল। প্রকৃতিতে বিরাজ করছিল শুনশান নীরবতা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দ্রুত অযু-গোসল শেষে নাস্তা সেরে নিলাম। পরে ওস্তাদ আদেল বললেন প্রস্তুত হতে। আমরা জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। কোথায় না কোথায় যেতে হয় কে জানে? মোবাইলটা আগেই ভালোভাবে চার্জ দিয়ে রেখেছিলাম। কারণ কোনো ক্যামেরা ছিল না। কোথাও ছবি তুলতে হলে এর মাধ্যমেই প্রয়োজন সেরে নিতে হবে।

জানলাম- আজ আমাদের নিয়ে যাবে ‘কেল্লা কায়েতবাই’। এ কেল্লাটির রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। একটি বাসে আমরা পঁচিশজনের মতো উঠলাম। দুর্গে পৌঁছতে হলে মান্দারাহ স্টেশন হতে ত্রিশ মিনিট যেতে হয়। রাস্তা ভূমধ্যসাগরের পাশ ঘেঁষেই। আমাদের বাসটি সরাসরি দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে এসে থামল। এটিই মূল প্রবেশপথ। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে পর পর কয়েটি ধাপ অতিক্রম করে ভেতরে যেতে হয়। আমরা ট্রাভেল গাইডকে সঙ্গে নিয়ে কায়েতবাই দুর্গে প্রবেশ করলাম।

কেল্লা কায়েতবাই আলেকজান্দ্রিয়ার ফারুস দ্বীপের একেবারে শেষপ্রান্তে অবস্থিত। যা পশ্চিম আলেকজান্দ্রিয়ার সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছে। এটি নির্মিত হয়েছে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘরের স্থানে। বাতিঘরটি ৭০২ হিজরিতে সুলতান আল-নাসের মুহাম্মাদ বিন কালাউনের শাসনামলে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ৮৮২ হিজরিতে সুলতান আশরাফ আবু নাসর কায়েতবাই এই দুর্গটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন, কাজ শেষ হয় ৮৮৪ হিজরিতে। অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে সমগ্র আরব অঞ্চলকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় এবং মিশরে তাদের ঘন ঘন আক্রমণকে প্রতিহত করতেই এটি নির্মাণ করা হয়।

মামালেক রাজবংশের শেষ সুলতান কানসুয়াহ আল-গাওরি দুর্গটির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ফলে এটির গুরুত্ব আরো বাড়ে। সবশেষে তিনি অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও এটিকে সুসজ্জিত করে তোলেন। আমরা দেখলাম দুর্গটি চতুর্ভুজ আকৃতির, তিনদিক থেকে সাগরঘেরা। দুর্গটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে তার প্রধান টাওয়ার। রয়েছে ভেতরের ও বাইরের প্রাচীর। ভেতরের প্রাচীরে রয়েছে সৈনিকের ব্যারাক ও অস্ত্রের গুদামঘর। বাইরের প্রচীরগুলো রক্ষাবূহ্য হিসেবে চারদিক থেকে মিলিত হয়ে আছে। এগুলো পূর্ব দিকের দেয়াল বাদে সমান তালে উঁচু হয়েছে। ওই দেয়ালটিতে সৈনিকদের আত্মরক্ষায় অনেকগুলো ছিদ্র রয়েছে। এগুলো দিয়ে উপযুক্ত সময়ে তীর নিক্ষেপ করা হতো।

প্রধান টাওয়ারটি তার ভেতরের আঙ্গিনায় দেখতে চতুর্ভুজ আকৃতির একটি বড় কেল্লার মতো। এটি তিনতলা বিশিষ্ট, চারটি মূল টাওয়ারের মাঝে অর্ধবৃত্তাকৃতির আরো অনেকগুলো টাওয়ার রয়েছে। যেগুলো উপরের খোলা খিড়কি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। প্রধান টাওয়ারটি থেকে এগুলো বেশ বড় বড়। তীর নিক্ষেপের জন্য এগুলোতেও ছোট ছোট ছিদ্র করা আছে। প্রথম তলায় রয়েছে দুর্গের মসজিদ। এতে প্রতিরক্ষা অপারেশনের সময় সৈনিকরা খুব সহজেই এখান থেকে অতিক্রম করতে পারত। গাইড জানালেন- মসজিদটির একটি উঁচু মিনার ছিলো। সম্প্রতি এটি ধ্বসে পড়েছে।

দ্বিতীর তলায় রয়েছে কয়েকট সুড়ঙ্গপথ ও কক্ষ। এখানকার বড় কক্ষটি তৃতীয়তলা পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে। এখানেই নাকি সুলতান কায়েতবাই বসতেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে দূরের জাহাজগুলো পর্যবেক্ষণ করতেন। এ তলায় সৈনিকদের রুটি বানানোর জন্য যাতা ছিলো। আরো ছিলো অন্যান্য সরঞ্জামাদি। ছাদে গিয়ে বুঝলাম, যদি এখান থেকে দূরবিন স্থাপন করা হয়, তবে গোটা আলেকজান্দ্রিয়া শহরকেই একসঙ্গে দেখা যাবে। কারণ, দুর্গটি তিনতলা বিশিষ্ট হলেও বেশ উঁচু। যার ফলে তখন কোথাও কোনো আক্রমনের আশঙ্কা দেখা দিলে অনেক আগেই সার্বিক প্রস্তুতি সেরে ফেলা যেতো। সবদিক মিলিয়ে দুর্গটি গোটা আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ খুব ভালোভাবেই করেছিলো।

এ বিষয়গুলো ছাড়াও আরো অতিরিক্ত কিছু বিষয় আমরা জানতে পেরেছি ছোট ছোট চিরকুটগুলো পড়ে। এগুলো দুর্গের ভেতরের জিনিসগুলোর গায়ে সংযুক্ত ছিলো। ইংরেজি এবং আরবিতে ছিলো এই লেখাগুলো। কোথাও বুঝতে কোনো সমস্যা হলে গাইড তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এসব কারণে দর্শনার্থীদের কাছে কোনো কিছু অস্পষ্ট থাকল না। এখানে আমরা ঘুরে ফিরে সবকিছু দেখার সঙ্গে রীতিমত ছবি তোলার কাজটাও সেরে নিচ্ছিলাম, যাতে এ দুর্গের সঙ্গে নিজেকে চিরস্বরণীয় করে রাখতে পারি। ছবি তোলা ও সবকিছু দেখা শেষ হলে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলাম।

আগেই বলেছি এই দুর্গটি তিনদিক থেকেই সাগরঘেরা। পাঠক বুঝতেই পারছেন সাগরটি ভূমধ্যসাগর। তবে আলেকজান্দ্রিয়ায় ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য স্থানের পানির তুলনায় এখানকার পানি অতি স্বচ্ছ, নীলাভ বর্ণের। এতে করে সাগর তলে থাকা পাথরগুলোও পরিষ্কার দেখা যায়। আমরা পাশে থাকা দুর্গের বাইরের মোটা প্রাচীরের উপর উঠলাম। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সাগর চোখে পড়ে। সেই দৃশ্যটি সত্যিই চোখজুড়ানো। হৃদয় গহিনে আনন্দ জোগায় আর তোলে পরিতৃপ্তির ঢেউ।

আজও সে দৃশ্যটি মনে হলে আনন্দের রেখাপাত করে। প্রকৃতই আল্লাহর এই দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত। এখানে আর বেশি দেরি করতে পারলাম না। একটু পরই গাড়িতে চড়ে বসার ডাক এলো। আমরা ফটাফট আরো কিছু ছবি তুলে ফিরে গেলাম। দুপুরের খাবার শেষে এলাম সামান্য বিশ্রামের জন্য। প্রখর রৌদ্র দুপুরে শরীর একটু বিশ্রামই চাচ্ছিল। সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর। মন চাইলেও আর অন্য কোথাও বেরুনো সম্ভব হলো না। ঠিক করলাম পড়ন্ত বিকেলে মুন্তাজা পার্ক ঘোরতে বেরুবো।

পড়ন্ত বিকেল। ক্লান্ত দুপুর। সারা দিনের সূর্যের চোখ রাঙানি এখন নেই। রক্তিম লালিমায় পশ্চিম দিগন্তে সামান্য হেলে পড়েছে। গোধূলির নির্মল হাওয়াও থেমে থেমে বইতে শুরু করেছে। আকাশে ডানা ঝাপটে উড়ছে ক্ষুদে ক্ষুদে পাখির ঝাঁক। আমরা চার-পাঁচজন বন্ধু তৈরি হলাম ‘মুন্তাজা পার্ক’ ঘুরতে। মিশরের বিখ্যাত পার্কগুলোর একটি এই মুন্তাজা পার্ক। আলেকজান্দ্রিয়ায় এটি সবচেয়ে বড় ও সুন্দর। সাগরের কোল ঘেঁষে  অবস্থিত এ পার্ক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। বিশেষ করে নতুন পর্যটকদের প্রাথমিক তালিকাতেই থাকে এ মুন্তাজা পার্ক।

আলেকজান্দ্রিয়ায় থাকতেও এখানে এসেছিলাম কয়েকবার। এবারও আসলাম। যতই দেখি তৃপ্তি কিন্তু মেটে না। প্রতিবারই যেন পার্কটি নবরূপে দর্শনার্থীদের চোখে ধরা দেয়। নতুন নতুন চমক নিয়ে হাজির হয়। আমরা বেরুলাম বিকেল পাঁচটায়। প্রত্যেকের গায়ে হালকা রঙের টি-সার্ট। যেন সবুজ বৃক্ষের আবরণে আমরাও সবুজের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই। আট পাউন্ড দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। এখানে রয়েছে কয়েকটি বাগান, যার মোট দৈর্ঘ্য ৩৭০ একর। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পূর্বপ্রান্তে মুন্তাজা গ্রামে এটি অবস্থিত বলে একে ‘হাদিক্বাতু মুন্তাজা’ বা ‘মুন্তাজা পার্ক’ বলা হয়। রাজধানী কায়রো থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৩৮ মাইল বা ২২১ কিলোমিটার। এর ব্যাপ্তি পুরো মুন্তাজা উপদ্বীপ জুড়ে।

মিশরের পূর্ববর্তী রাজবংশ উলুবি পরিবারের মালিকানায় ছিলো এ বাগানটি। এখানে সাঁতার কাটার জন্য রয়েছে পাঁচটি বিচ। এগুলোর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম- আয়েদাহ, কিউপেট্রা, সিরামিস, ফিনিশিয়া ইত্যাদি। এরমাঝে মুন্তাজা রাজপ্রাসাদের দিকে দুটি বিচ রয়েছে। পার্কটি আজ থেকে প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি আগে সুলতান খাদিভির (যাকে দ্বিতীয় আব্বাস হিলমি বলা হত) নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্কটির ভেতরে অনেকগুলো পর্যটনস্থল রয়েছে। আরো আছে খাবার হোটেল, ভ্রমণকেন্দ্র, খেলার মাঠ আর কাঠের তৈরি কুটির। এখানে রয়েছে ক্বসরে মালিক ফারুক বা বাদশাহ ফারুদের রাজ প্রাসাদ। এই প্রাসাদের ভেতর রয়েছে রোমান সাম্রাজ্যের সময় তৈরি ঘড়ি, তৎকালীন সময়কার চায়ের দোকান। রাজপ্রাসাদের কাছে প্রসিদ্ধ সিনেমা হল, হিরমুলুক ও সালামুলুক নামে রাজপ্রাসাদটির পাশে আরো দুটি প্রাসাদ রয়েছে। যেগুলোর নির্মাণশৈলী অতি বিরল প্রকৃতির।

হিরমুলুকে থাকতেন প্রাসাদের নারী আর তাদের সেবিকারা। আর সালামুলুকে থাকতেন রাজ্যের বিশেষ বিশেষ পুরুষরা। আরো আছে নানা জাতের বৃক্ষ, বন-বনানী, হরেক রকমের ফুল, রয়েছে অভিজাত হোটেল ‘হিলনান ফিলিস্তিন’। এটি আন্তর্জাতিক মানের একটি পাঁচতারা পর্যটন হোটেল। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়। পার্কের একেবারে নিচে পাতাল কারাগার, রয়েছে জলপ্রপাত, আছে অনেকগুলো ক্যাফেটেরিয়া। যাতে খুব চমৎকার কিছু সময় পার করা সম্ভব। এর ভেতরকার ভবনগুলো অটোমান সাম্রাজ্য এবং ফ্রান্স শাসনামলের আদলে তৈরি। রয়েছে অনেকগুলো ফুলবাগান। উদ্ভিদরাজি, শিশুপার্ক, গ্রীষ্মকালীন নাট্যমঞ্চ এবং জমিয়ে আড্ডা দেবার মতো বিচিত্র স্থান।

কোনো একদিন কায়রো থেকে কিছু সিনিয়র ভাই এসেছিলেন পার্কটি ঘুরতে। সেদিন আমরাও তাদের সাথী হয়েছিলাম। যেহেতু এর আগে ছয়টি মাস আমাদের আলেকজান্দ্রিয়ায় থাকতে হয়েছিল, খুব আনন্দ হয়েছিল তখন। আমরা পার্কটির শেষপ্রান্তে সাগর কিনারে এসে গোল হয়ে বসেছিলাম। জামাল ভাই, আশরাফ ভাই অনেকগুলো পার্ট নিয়েছিলেন। আখতার ভাই কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় কয়েকটি ধাঁধা বলেছিলেন। যদিও এর একটিও আমরা খণ্ডন করতে পারিনি, কিন্তু হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল।

শরিফ ভাই কুস্তিতে ভালো লড়েছিলেন। চোখ বেঁধে হাতে একটি লাঠি নিয়ে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে মাজহার ভাই শুধু লাঠিটিই ভেঙ্গেছিলেন। এদিকে অতি দ্রুত দৌড় দিতে গিয়ে সাদী একটি গর্তে পড়ে গিয়েছিল। তখন আসেম ভাই ছাড়া আর সবাই হেসে কুটিকুটি হয়েছিল।

সবমিলিয়ে মুন্তাজা পার্কের ওই আড্ডাটি আমাদের কাছে চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে। আজ একবছর পর পার্কটি ঘুরতে এসে দু’বছর আগের সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেলো। সেই সঙ্গে জামাল ভাইসহ আরো অনেককে মিস করলাম। কারণ তারা ইতোমধ্যে স্বদেশের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। আমরা এখানে আগের স্মৃতিময় পথগুলো আবারও ঘুরে দেখতে লাগলাম। এদিকে খেয়াল রাখলাম যাতে ঘন অন্ধকার হবার আগেই ফিরে যেতে পারি।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!