এখানে ছুটির দিনগুলোতে কাজ করলে অন্যান্য দিনের তুলনায় দ্বিগুণ মজুরি পাওয়া যায়। তাই আমার মতো নিম্ন আয়ের কর্মীরা আনন্দ নিয়ে এই দিন কাজে যোগ দিয়েছি। আবার অনেকে শিফন ডিউটি থাকার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করছে।
কাজ করতে করতে তখন আমার কপাল বেয়ে তপ্ত পানি ঝরছিল। গায়ের ইউনিফর্মের হাতায় পানিটুকু মুছে বললাম, “ঠিক আছে ভাই। আসতে চেষ্টা করব।” তিনি ‘ওকে’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
কিছুক্ষণ আমার পরিচিত প্রবাসী সঙ্গীত শিল্পী আনোয়ার ভাই বলল, “ওমর ভাই, আজকে আপনার ডরমিটরিতে আমি আসছি গান গাইতে। সেখানে অষ্টম বাংলাদেশ বইমেলাও হবে। হাইকমিশনার উপস্থিত থাকবেন অনুষ্ঠানে, তিনি সাধারণ কর্মীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইন করবেন।”
তার কথা শুনে আনন্দিত হলাম। যাক হাইকমিশনার আমাদের মতো নিম্ন আয়ের কর্মীদের খোঁজ নিতে আসবেন। আমি জানি এই কর্মসূচির কথা। তবুও না জানার ভান করে বললাম, “আচ্ছা।” আবারও মিথ্যা বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।
ভাবতে ভাবতে মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমি কোনো কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে পারব না। আমার ডিউটি শেষ করে যেতে যেতে রাত ৯টা বাজবে।ততক্ষণে সব কর্মসূচি শেষ হয়ে যাবে। আমার মন খারাপ দেখে আমাদের অফিসার মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ কেন ওমর?”
মাসুদ ভাইকে বিস্তারিত খুলে বললাম। তিনি সব শুনে আমাকে কাজ শেষ হবার নির্ধারিত সময়ের তিন ঘণ্টা আগে বাসায় ফেরার অনুমতি দিলেন। আমি আনন্দিত হয়ে অফিস থেকে বের হলাম।
ডরমিটরির সামনে বাস থেকে নেমেই চলে গেলাম ক্যাপেল হাউজের চার তলার হলরুমে। সেখানে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে সাধারণ কর্মীদের মাঝে সচেতনামূলক ক্যাম্পেইন হচ্ছে, আর অষ্টম বাংলাদেশ বইমেলাও। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেখানে উপস্থিত আছেন রাষ্ট্রদূত মোস্তাফিজুর রহমান।
আমি হলরুমে ঢুকতেই আয়োজকদের একজন একটি রেজিস্ট্রি বইয়ে নিজের নাম লিখে নিবন্ধন করতে বলল। নিবন্ধিত হলে তিনি আমার দিকে একটি ফ্রি টি-শার্ট ও কিছু উপহার সামগ্রী দিলেন। হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। এগুলো আমাকে দেওয়া হচ্ছে কেন? আমি তো এগুলোর জন্য আসিনি।
বিনামূল্যে কিছু পেতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু উপহারগুলো আমাকে লজ্জিত করলো। কারণ, উপরে আসার আগে নিচে অনেক অসহায় কর্মী দেখে এসেছি, যাদের অবস্থা আমার চেয়ে খারাপ। তাদের কোম্পানিতে কাজ নেই, কারও কোম্পানি তিন মাস যাবত বেতন দেয় না। তো এই উপহার আমার চেয়েও তাদের বেশি প্রয়োজন ছিল।
উপস্থিত দর্শকদের দেখে ব্যথিত হলাম। এত দারুণ একটি কর্মসূচি, অথচ অল্প কয়েকজন দর্শক। যাদের এই ব্রিফিং-এ বেশি উপকার হতো, তাদের কাউকে পেলাম না। হয়তো অনুষ্ঠানটি ঘরোয়া হওয়ায় অনেকেই উপস্থিত হতে পারেনি।
এত দারুণ একটি সচেতনামূলক অনুষ্ঠান যদি খোলা মাঠ কিংবা আরও বেশি দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে আরও বেশি সংখ্যক অভিবাসী কর্মী উপকৃত হতো। তবুও ভালো লাগল। এরকম সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আরও বেশি বেশি করা হোক।
পাশেই দেখলাম সিঙ্গাপুরে জনপ্রিয় কবি ও আরও অন্যান্য লেখকদের, তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম কুশলাদি বিনিময় করার জন্য। সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাহিত্য সংগঠনের উদ্যোগে বইমেলা হচ্ছে। সেখানে জনপ্রিয় সব লেখকদের বই সাজিয়ে রাখা হয়ে হয়েছে। প্রবাসী কবি জাকির ভাইয়ের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, আজকে হাইকমিশনার কিছু প্রবাসী লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন।
তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সব ক্লান্তি ভুলে গেলাম। কিছু কিছু মানুষের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে। ওরা তখন যা বলে, তাই করতে ইচ্ছে করে। আমি কথা না বাড়িয়ে তার সাথে হাঁটতে জানতে পারি- আজকে পেঞ্জুরু রিক্রিয়েশন সেন্টারের জেটিসি কর্তৃপক্ষ তাদের লাইব্রেরিকে এখানে আমন্ত্রণ করেছে বইয়ের ক্যাম্পেইন করার জন্য।
তিনি আমাকে আরও জানালেন, পাঠক ছাড়া সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই, বাংলা সাহিত্যের পাঠক বাড়াতে মাইগ্রেন্ট লাইব্রেরি কাজ করছে। তাদের কর্মসূচিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
- অভিবাসন কর্মীদের আবাসস্থল ডরমিটরিগুলোতে গিয়ে তাদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া।
- যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখি করেন, সেসকল লেখক ও কবিদের একত্রিত করা।
-লেখক ও পাঠকদের নিয়ে লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করা।
পাঠকদের তারা সহজ শর্তে বই ধার দেয় ৩০ দিনের জন্য। ইচ্ছে করলে কেউ আরও বেশিদিনও রাখতে পারবে। তবে বই পড়ার শেষে ফেরত দিতে হবে।
কথায় কথায় রিক্রিয়েশন সেন্টারে চলে আসি। যেখানে মাইগ্রেন্ট লাইব্রেরির ব্যানারে ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। শত শত লোক বই দেখছে। কেউবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে প্রিয় লেখকদের বই।
মাইগ্রেন্ট লাইব্রেরির আরেক উদ্যোক্তা রিপন চৌধুরী আমাকে দেখে এগিয়ে এসে করমর্দন করে জানান, আজকে তারা একশ’ বই ধার দিয়েছেন। এমনকি অনেক পাঠক তাদের প্রিয় লেখকদের বইয়ের নাম দিয়েছেন। যেন আগামীতে তাদের পছন্দের বইগুলো আনা হয়।
আগত বইপ্রেমীদের দেখে আনন্দে আমি উদ্বেলিত হই। প্রবাসেও এত সাহিত্যপ্রেমী! ভাবতেই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। হয়তো এই ত্যাগী উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য ছড়িয়ে পড়বে প্রবাসের আনাচে-কানাচে।
কিছু সাহিত্যপ্রেমীদের সাথে সময় পার করে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে একধরনের স্বর্গীয়া সুখ অনুভব করতে করতে বাসার দিকে রওনা দেই।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এ লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |