প্রবাস জীবনে জুয়া ও সর্বনাশ

কিছুদিন পরপর শুনি আলী ভাই ‘ফোরডি’ পেয়েছেন। আমি শুনি আর জ্বলেপুড়ে মরি। কারণ ধারণা করা হয় ‘ফোরডি’ হলো বিনা পরিশ্রমে টাকা আয়ের সহজ রাস্তা।

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2018, 07:08 AM
Updated : 4 Feb 2018, 07:08 AM

‘ফোরডি’ হলো চার ডিজিট নাম্বার। চারটি নাম্বারে কাটা হয় এবং প্রতি শনি, রোব আর বুধবার এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়। টাকার উপর নির্ভর করে দেওয়া হয় প্রাইজমানি।

আমি এখনও ‘ফোরডি’ খেলিনি। সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষ ‘ফোরডি’ খেলেন। বিকেলে ফোরডি শপে গেলে দেখা যায় বয়স্ক ও তরুণদের লম্বা কিউ। বাংলাদেশি কিছু প্রবাসীদেরও দেখা মেলে এখানে।

সিঙ্গাপুরে আরেক ধরনের জুয়া আছে, তার নাম ‘টোটো’। ‘টোটো’ হলো অনেকগুলো নাম্বারের সমষ্টি। এটাকে বলা হয় নাম্বারের খেলা। সিস্টেম ৭ নাম্বারে ৭ ডলার, সিস্টেম ৮ নাম্বারে ২৮ ডলার, সিস্টেম ৯ নাম্বারে ৮২ ডলার, এমন করে সিস্টেম ১২ নাম্বারে ৯২৮ ডলার পে করতে হয়।

কমপক্ষে তিনটি নাম্বার মিলে গেলেই প্রাইজমানি পাওয়া যায়। আর ৬ নাম্বার মিলে গেলে প্রথম পুরস্কার ১ মিলিয়ন ডলার। সপ্তাহে দুই দিন এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়। সোম ও বৃহস্পতিবার।

সোমবারে ড্রতে যদি কেউ প্রথম পুরস্কার না পান, তাহলে বৃহস্পতিবার প্রথম পুরস্কার হবে দুই মিলিয়ন। বৃহস্পতিবার যদি কেউ প্রথম পুরস্কার না পান, তাহলে পরের সোমবার প্রথম পুরস্কার হবে ৪ মিলিয়ন। এভাবে সর্বোচ্চ ৮ মিলিয়ন পর্যন্ত যাওয়া যায়। যদি ৮ মিলিয়নও কেউ না পান, তাহলে এ আট মিলিয়ন সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরের আরেকটি জুয়া হলো ‘বিগ সুইফ’। মাসে ২.২ মিলিয়ন ডলারের লটারি হয়। কেউ একবার পেয়ে গেলে কয়েকবছর তাকে কাজ করতে হবে না, ‘যদি লাইগা যায়’ ধরনের। এটা বাংলাদেশের লটারির মতোই।

সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন খেলার মধ্যে ফুটবলের উপর জুয়া খেলা হয় বেশি। আর প্রতিদিন ফুটবলের উপর বাজি তো আছেই। ঘোড়দৌড়ের উপরও খেলা হয় হাজার হাজার ডলারের জুয়া।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ জুয়া হলো ক্যাসিনিও। আমার মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর বসে এ ক্যাসিনিওতে। এখানে কেউ একরাতে কোটিপতি হয় কেউবা জিরো। আমার এক বন্ধু প্রায়ই ক্যাসিনিওতে যায়। একদিন এক লাখ ডলার জিতে আমাকে ফোন দিলো। ট্যাক্সি নিয়ে নিদিষ্ট জায়গায় যেতে বললো, বিপদে পড়েছে মনে করে আমি গেলাম।

সেখানে যাওয়ার পর সে আমার ট্যাক্সি ভাড়া দিলো। তারপর ব্যয়বহুল হোটেলে নিয়ে বসালো। ভাবসাব দেখে বুঝে ফেলি তার কাছে এ মুহূর্তে অনেক টাকা, তাই আমি কিছু না বলে তাকে ফলো করে গেলাম। সেখানে সে দামি খাবারের পাশাপাশি হুইস্কি নিয়ে বসলো।

সে হুইস্কি খায় আর আমি বসে বসে মজা নেই। নেশাগ্রস্ত মানুষের পাশাপাশি থাকার একধরনের আনন্দানুভূতি হয় আমার। তখন তাদের মনের দরজা খুলে যায়। যা বলে মন থেকেই বলে। যখন সে সম্পূর্ন নেশাগ্রস্ত হয় তখন তার মনের কথা, তার স্বপ্নের কথা বলে থাকে। তারপর তাকে ধরে রুমে পৌঁছে দিলেই আমার কাজ শেষ।

তাকে বলেছিলাম যা জিতেছো তা বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, নিজের কাছে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। সে আমার কথা শুনলো না। ফলাফল তার পরদিন রাতে কল দিয়ে আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘বিশ ডলার নিয়ে হাউজের নিচে দাঁড়াও, আমার কাছে ট্যাক্সি ভাড়া দেবার মতো কোন টাকা নেই।’

সেদিন আমি ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে সহায়তা করেছিলাম। কয়েকদিন পর শুনলাম সে নাকি শুধু কাঁচামরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছে কয়েকদিন। এক রাতে সর্বোচ্চ খুইয়ে এমনকি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখিনি।

আসল কথায় আশা যাক। কয়েকদিন পরপর ‘ফোরডি’ পাওয়ার কারণে আলী ভাইয়ের নাম হয়ে গেছে ‘ফোরডি আলী’। এখন তাকে সবাই ‘ফোরডি আলী’ নামেই চেনেন।

লোকজনের মুখে শুনতে শুনতে আমারও ফোরডির প্রতি তীব্র আগ্রহ তৈরি হয়। আমরা মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। খারাপ জিনিসের কথা বারবার শুনতে শুনতে সে খারাপ জিনিসের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

তাই আমি লোভের কাছে হার মানলাম। লোকের মুখে ‘ফোরডি আলী’ ভাইয়ের নাম শুনতে শুনতে আমারও ফোরডি খেলে বড়লোক হবার খুব ইচ্ছা জাগলো। যে কথা সেই কাজ, একদিন আমি ফোরডি, টোটো, বিগ সুইফ মিলিয়ে তিনশ ডলার খরচ করলাম। ‘যদি লাইগা যায়’ তাহলে আর প্রবাসে থাকতে হবে না। এক দানে কোটিপতি।

কিন্তু হায়! রেজাল্ট পেলাম আমার তিনশ ডলারই পানিতে গেলো। রাগে-ক্ষোভে ‘ফোরডি আলী’ ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, ‘ওই মিয়া, আপনি ফোরডি পান তা আবার সবার কাছে বলে বেড়ানোর দরকার কি? আর আপনি এত ঘনঘন ফোরডি পেলে সিঙ্গাপুরে কী করছেন?’

ফোরডি আলী ভাই তার সাদা ঝকঝকে দাঁত দুটি বের করে বলল, ‘আপনি এত উত্তেজিত কেন? কী হইছে ঠাণ্ডা মাথায় খুলে বলেন।’

আমি জবাব দিলাম, ‘আপনি ঘনঘন ফোরডি পান তা শুনে আমিও লোভে পড়ে তিনশ ডলার খরচ করে ফোরডি টোটো কেটেছিলাম। কিন্তু এক টাকাও পাইনি। আপনার জন্যই আমি আজ এতগুলি ডলার খুয়ালাম। আপনি যদি সবার কাছে বলে না বেড়াতেন তাহলে আমার আর জুয়া খেলার লোভ হত না।’

আলী ভাই এবারও সহজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিল, ‘তাহলে শোনেন ভাই, আমি কোনো ফোরডি পাই নাই। জীবনে একবার পেয়েছিলাম দশ হাজার ডলার। কিন্তু কিছুলোক সেই পাওয়াটাকে কয়েকদিন পরপর পাওয়ায় পরিণত করেছে। আপনিই বলুন যদি কয়েকদিন পরপর ফোরডি পেতাম তাহলে কি আমি এখানে পড়ে আছি? আর জুয়া খেলে আজ পর্যন্ত কেউ লাভের মধ্যে নেই। বছর শেষে হিসাব করলে দেখা যায় যত জিতেছে তারচেয়ে বেশি হেরেছে।’

তার কথা শুনে আমি শান্তভাবে ভাবতে লাগলাম, ঠিকই তো। কিছু লোক আলী ভাই ফোরডি পেয়েছে এ কথা প্রচার করে লোকদেরকে ফোরডির প্রতি লোভ যোগাচ্ছে। আর আমার মতো বোকারা প্রতিনিয়ত এ লোভে পড়ে কষ্টার্জিত টাকা জুয়া খেলে নষ্ট করছে।

আলী ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তওবা করলাম, এ জীবনে আর বিনা পরিশ্রমে সম্পদশালী হতে যাবো না। নিজে পরিশ্রম করে চারটা ডালভাত খেয়ে নাকে সরিষার তেল দিয়ে শান্তির ঘুম দেবো।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এ লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!