প্রবাসে ডিজিটাল জীবনযাপন

সিঙ্গাপুরে আসার এক মাস পরের কথা। এক বন্ধুর সাথে চা পান করতে গেলাম। সে একটি মেশিনে পয়সা দিয়ে কয়েকটা চাপ দিতেই গরম এক কাপ চা বের হয়ে এলো!

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2018, 06:43 AM
Updated : 31 Jan 2018, 06:43 AM

ধূমায়িত চা হাতে নিয়ে আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, এটা কী করে সম্ভব! নিশ্চয় এর ভেতর কেউ বসে আছে। পয়সা দিতেই সে দ্রুত চা দেয়। বন্ধুর সামনে বোকা হয়ে যাব বলে সেদিন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে মনে মনে হাজারটা প্রশ্ন উকি দিয়েছিলো।

কয়েকদিন পর দেখলাম, এক ব্যক্তি এসে মেশিনটি খুলে সবকিছু সেটআপ করছে। পানি চা, কফি সবকিছু নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হচ্ছে, আর পয়সা দিলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চা বা কফি হয়ে বের হয়ে আসে।

সিঙ্গাপুরে আসার পরদিনই কোম্পানি থেকে একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হলো। পরিচয়পত্রে আমার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া আছে। সেই পরিচয়পত্রটি ট্যাপ করলেই ডরমিটরির সিকিউরিটি গেইট খুলে যায়। আমি ভেতরে ঢুকতেই আবারও গেইট বন্ধ হয়ে যায়।

রুমে কোনো তালা নেই, একই পরিচয়পত্র দরজায় ট্যাপ করলে ছোট্ট একটি শব্দ করে সবুজ বাতি জ্বলে উঠে। আর দরজার হাতল ধরে মোচড় দিলেই দরজা খুলে যায়।

অফিসে ঢোকার আগেও একই পরিচয়পত্র দরজায় ট্যাপ করে ঢুকি আর বের হই। সেই মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠায় আমার অফিসে আগমন ও নির্গমনের। আমি অবাক হয়ে ভাবি, কী করে সম্ভব একই পরিচয়পত্র দিয়ে এত কাজ করা!

সারাজীবন আমি বাসে টিকেট কেটে কিংবা কনট্রাকটরদের হাতে টাকা দিয়ে বাসে বা ট্রেনে চড়ে অভ্যস্ত। কিন্তু সিঙ্গাপুর এসে সব পালটে গেল, একটি কার্ডে টাকা টপআপ করে সেই কার্ড ট্যাপ করে বাসে বা ট্রেনে উঠতে হয়। ট্যাপ করে বাস বা ট্রেন থেকে নামলেই নির্ধারিত ভাড়া কার্ড থেকে কেটে নেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরে অসংখ্যা সাইকেল রাস্তায় সাজিয়ে রাখতে দেখে আমি অবাক হলাম। এখানে-সেখানে এত সাইকেল সাজিয়ে রাখা হয়েছে কেনো? পরে জানতে পারি, এসব সাইকেল মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে স্ক্যান করে তালা খুলে আমরা চালাতে পারব। সাইকেল নিয়ে যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া যাবে এবং যেখানে খুশি সেখানে পাকিং করাও যাবে।

সাইকেলগুলো কারও ব্যক্তিগত নয়। তবে সবাই নিজের মোবাইলে অ্যাপ ব্যবহার করে সাইকেলের লক খুলে নিতে পারে। চালাতে চাইলে কোম্পানিগুলোর অ্যাপ খুলে রাখতে হবে।

অ্যাপস খুলে বার কোড স্ক্যান করে সাইকেলগুলো যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। স্মার্টফোন অ্যাপে আশপাশে সাইকেল কোথায় আছে তা দেখা যায়। সাইকেলের সংখ্যা এত বেশি যে খুঁজতে হয় না। রাস্তায় চোখের সামনেই সাইকেল পড়ে থাকে। সব সাইকেলে জিপিএস লাগানো।

আমি ভেবে উঠতে পারি না, কীভাবে হাজার হাজার সাইকেল রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হলো। আর নামেমাত্র রেজিস্টেশন ফি দিয়ে এরা ব্যবসা করে কেমনে?

ডিজিটাল জীবনযাপনের শেষ সংযোজন হলো কয়েকদিন হল।আগে মাস শেষে কোম্পানি পে-স্লিপ, হাজিরার রেকর্ড হাতে ধরিয়ে দিতো, আর এখন দুটি অ্যাপডাউনলোড করে সব তথ্য ঘরে বসে মোবাইলেই জানা যাবে। অ্যাপস দুটি হলো ‘ওয়াক ডে’ এবং ‘এসএএফ ফ্লোরি’।

‘ওয়াক ডে’তে জানা যাবে কোম্পানিতে আমার যাবতীয় তথ্যাবলী। কোম্পানি থেকে কত দিনের ছুটি পাওনা ও এর মাধ্যমে ছুটির জন্য আবেদন করতে হবে ছুটি মঞ্জুর হলে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জানানো হবে। আর এসএএফ ফ্লোরি কর্মের তথ্যাবলী ও বেতনের রশিদ বই।

চাংগি বিমানবন্দরে পুলিশ ক্লিলিয়ারেন্সের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশ পাসপোর্টে সিল মেরে দিলেই বিমানবন্দরের ভেতর ঢুকব। অবাক হয়ে দেখলাম, আমি যে লাইনে দাঁড়িয়েছি সেখানে বেশিরভাগ বাংলাদেশি, অন্যান্য লাইনে সব ইউরোপিয়ান। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এখানে ইউরোপিয়ানদের জন্য বুঝি আলাদা ব্যবস্থা।

এমন সময় বিমানবন্দরে নিয়োজিত এক কর্মী এসে বলল, স্যার, আপনার তো ডিজিটাল পাসপোর্ট। আপনাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। তার বর্ণনা অনুসারে আমি পাসপোর্ট স্কানিং করে আর আঙুলের ছাপ দিতেই গেট খুলে গেল। মনে মনে খুশি হয়ে ভাবতে লাগলাম, এখন আর পুলিশের হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।

মনে মনে বাংলাদেশ সরকারকে অসংখ্যা ধন্যবাদ দিলাম। যাক, ডিজিটাল পাসপোর্ট করার কারণেই খুব সহজেই গেইট পার হতে পারলাম।

লেখক: সিঙ্গাপুর প্রবাসী

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!