প্রবাসে মিতব্যয়ী জীবনযাপনের কথা

নিজের আর্থিক সচ্ছলতা ও বিপদের দিনে আর্থিক নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেকেরই মিতব্যয়ী হওয়াটা জরুরি। আর প্রবাসীদের মিতব্যয়ী হওয়াটা বেশি জরুরি।

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2018, 05:53 AM
Updated : 7 March 2018, 05:53 AM

সিঙ্গাপুরে আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন যিনি মাস শেষে বেতন পাবার পর যৎসামান্য বাড়িতে পাঠিয়ে সবই নিজের জন্য ব্যয় করতেন। জুয়া খেলা, মদ্যপান, আজেবাজে ফূর্তি- সবই করতেন। তাকে একদিন বললাম, “কষ্টের টাকা এভাবে খরচ না করলেও পারেন ভাই। বাড়িতে না দেন, অত্যন্ত নিজের জন্য সঞ্চয় করুন।”

উনি আমাকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “আমাকে জ্ঞান দেওয়া লাগবে না, নিজের চড়কায় নিজে তেল দেন। আমার উপার্জিত টাকা কীভাবে খরচ করব, তা আপনাকে বলতে হবে না।” সেদিন আমি লজ্জিত হয়ে আর কথা বাড়াইনি।

কয়েক মাস আগে সেই ব্যক্তিকে কোম্পানি বরখাস্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে গিয়ে সে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। আমাকে একদিন কল দিয়ে আর্থিকভাবে সহযোগিতা চায়। ভেবেছিলাম তাকে কটু কথা বলব। কিন্তু তার অবস্থা দেখে আর বলা হয়নি। শুধু এটুকু বললাম, “বেহিসাবি খরচ না করে যদি কিছু কিছু সঞ্চয় করতেন, তাহলে হয়তো আজ  অন্যের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে হতো না।”
আমি এমনিই একটু হিসেব করে খরচাপাতি করি। তবে আজকাল একটু বেশি। মনের মধ্যে ভয় হয়, কোম্পানি যদি দেশে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে কে আমাকে দুই টাকা দিয়ে সাহায্য করবে? কার কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইব?

আমাকে হিসেব করে খরচ করতে দেখে কিছু লোক টিপ্পনী কেটে বলে, “টাকা-পয়সা আজ  আছে কাল নেই, নিজের উপার্জিত টাকা যদি ইচ্ছেমতো খরচ না করি তাহলে এই টাকা পয়সা আয় করার মানে কী?” তাদের এই তামাশা দেখে আমি বিচলিত নই। অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে ‘কৃপণ’ খেতাব পাওয়া অনেক সম্মানের।

একবার আমি আর আমার এক বন্ধু বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন একজন দরিদ্র ব্যক্তি এসে সাহায্য চাইলে আমি হিসেব করে তিন দিনের জন্য নিজের খরচ রেখে তাকে অল্প কিছু সাহায্য করলাম। আমার বন্ধু কোনো হিসেব না করে নিজের কাছে যা ছিলো, তার সবই দিয়ে দিলো। আমাকে বললো, “দান করার সময়ও এমন হিসেব না করলে হয় না?”

আমি বলেছিলাম, “অন্যকে উপকার করতে গিয়ে নিজেকে পথে বসাতে পারব না। নিজের সর্বোচ্চ দান করার মাঝে গৌরব নাই, নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর দান করার মাঝেই গৌরব আছে।”

আমার আরেক প্রবাসী বন্ধু বেতন পাবার পর সব টাকাই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারপর অসহায়ের মত অন্যের কাছে হাত পাতেন। একসময় দেখলাম পরিচিত অনেকেই তার কাছে টাকা পায়। সে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে লজ্জায় ঘর থেকে বের হয় না।পাওনাদাররা তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। কেউ কেউ তাকে মারার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আমি সবাইকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে ঋণ পরিশোধের ভার নেই।

তাকে গিয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “এভাবে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে অন্যের কাছে ঋণ করার মানে কী? সবাই তো আপনাকে গালাগালি করে?” সে সহাস্যে জবাব দেয়, “পরিবারের সবাইকে খুশি রেখে নিজে গালাগালি শোনার মাঝেও আনন্দ আছে।”

কয়েকদিন আগে সে বিয়ে করতে ছুটিতে দেশে যায়। একদিন আমাকে কল দিয়ে বললো, “ভাই, আপনি ঠিকই বলেছেন। ঋণ করে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে আমার লাভ হয়নি। সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। সবাই ভাবে, আমার কাছে লক্ষ লক্ষ টাকা আছে। বিয়ে করব বলে খরচ না করে গলা শুকাচ্ছি। ভেবেছিলাম বাবা অন্তত বিশ্বাস করবে। বাবাকে বললাম, আমার কাছে কোনো টাকা নেই, কিছু টাকা দিন হাত খরচের জন্য। বাবা রেগে গেলো, আমার কাছে নাকি পাঁচ লক্ষ টাকা আছে, তবু মিথ্যা বলছি।” 

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “এইজন্য নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মিতব্যয়ী হওয়া দরকার ছিলো। প্রতি মাসে যদি সব টাকা বাড়িতে না পাঠিয়ে অল্প অল্প সঞ্চয় করতেন, তাহলে আজ  আপনাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।” সে নিজের ভুলের জন্য আফসোস করে লাইনটা কেটে দিল। 
আমার পকেটে টাকার পরিমাণ দেখে আমি খাবারের দোকানে খেতে যাই। নিজের সর্বোচ্চ ব্যয় করে রসনা বিলাসের কোনো মানে হয় না। আমি ভালো পোশাক, দামি ঘড়ি, দামি জুতা ব্যবহার করি না। তাই অনেকেই আমার সাথে তামাশা করে।

একদিন এক ছোট ভাই বললো, “কম দামি পোশাক পরে ফকিরের মতো জীবনযাপন করে কী লাভ? আপনি মারা গেলে তো সাথে করে সম্পদ নিয়ে যাবেন না। নাকি আপনার কবরে সম্পদ নিয়ে যাবেন?” 

আমি তাকে কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ, আমি এ ধরনের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি জানি সে বেহিসাবি খরচ করে, তাই সে চায় আমিও তার মতো বেহিসাবি হয়ে উঠি। আজকাল বেহিসাবি খরচ করা মানেই স্মার্ট, কলিজা বড় ইত্যাদি। আর একটু হিসেব করে খরচ করলেই আপনি কৃপণ, আপনার ধন পিঁপড়া খাবে। 

জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। অথচ বিশ্বের বহুসংখ্যক মানুষের এখনও নিয়মিত তিনবেলা খাবার জোটে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটায়।

পৃথিবীর সব মানুষ যদি মিতব্যয়ী হতো, তাহলে পৃথিবীতে কোনো দরিদ্র থাকতো না। কোনো শিশুকে না খেয়ে ঘুমাতে যেতে হতো না। আসুন মিতব্যয়ী হই। এর জন্য ‘কৃপণ’ খেতাব পাওয়া লজ্জার কিছু না।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এ লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!