দুরন্ত শৈশব মানে যেখানে নিয়মের বালাই নেই। ইচ্ছেমতো যা খুশি তাই করা যায়।
Published : 18 Nov 2017, 09:08 AM
আমাদের গ্রামে তখনও সভ্যতার অনেক ছোঁয়াই লাগেনি। বিজ্ঞানের ছোঁয়া বলতে ছিলো একটা রেডিও। এছাড়া আমাদের সবকিছুই ছিলো প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। আমাদের আনন্দের সব উপকরণ ছিল প্রকৃতি প্রদত্ত।
প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিলো খুবই অম্ল-মধুর। এই আমরা ছোটরা মারামারি করছি, আবার এই আমাদের গলায়-গলায় ভাব হয়ে যাচ্ছে। আর যেহেতু ছোটদের এই ঝামেলাতে বড়রা মাথা ঘামাতো না, তাই সেটা যত দ্রুত তৈরি হতো, তারচেয়ে দ্রুত মিটে যেত।
আমরা বড়দের বলতামও না আমাদের ঝামেলার কথা। কারণ, বললে উল্টো নিজেরই পিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো শতভাগ। কিছু খণ্ড খণ্ড ঘটনা এখনও মনে দাগ কেটে আছে।
আমি আর প্রতিবেশী আজাদ সমবয়সি হওয়াতে আমাদের বোঝাপড়াটা ছিলো দারুণ। আমাদের জুটি পাড়ায় খুবই বিখ্যাত ছিলো কারণে। আমাদের খেলাধুলার বিষয়ও ছিল একটু আলাদা।
একবার বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের তলায় আমরা খেঁজুরের কাঁটা উল্টো করে পুঁতে খেলনা ঘর তৈরি করেছিলাম। যার ফলে খেঁজুরের সুঁচালো মুখটা ছিল উপরের দিকে। মা ঝাড়ু দিতে গিয়ে সেটাতে পা দিয়ে ফেলেছিলো। তারপর সেই কাঁটা মায়ের পায়ে ফুটে গিয়েছিল।
এখনও চোখে ভাসে, মা উঠোনে বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে আর আমার বড় জামাই (আমাদের এলাকায় আমরা ফুপাকে জামাই বলে সম্বোধন করি) ছোন (শর্না) দিয়ে সেটা তোলার চেষ্টা করছে। মায়ের পা থেকে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
একদিন আমরা দু’জন মিলে কোথা থেকে ম্যাচ জোগাড় করে সেই আখের পাতার পালাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ম্যাচ জোগাড় করার বিস্তারিত আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু এরপরের ছুটোছুটি মনে আছে। কেউ চটের বস্তা কলের পানিতে ভিজিয়ে সেটা ফেলে দিচ্ছিলো পালার উপর, কেউবা বালি ছুড়ে দিচ্ছিলো, আবার কেউ দ্রুত পানি এনে ঢালছিলো। এরপর অবশ্য আমাকে কী ধরনের শাস্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিলো, সেটা আর মনে নাই।
শৈশবে আরও একটা কাজ আমাদের খুব পছন্দের ছিলো। পুকুরে নেমে সারাদিন ঝাপাঝাপি করা। আমাদের জন্য পুকুরের মালিকরা রীতিমতো পুকুর পাহারা দেওয়া শুরু করেছিলো। বিশেষ করে শান বাঁধানো ঘাট ছিলো যে পুকুরগুলোতে, সেইগুলোর উপর অত্যাচার একটু বেশিই হত। আমাদের লাফালাফির কারণে পুকুরপাড়ের মাটি ক্ষয়ে গিয়ে পাড় ভেঙে পড়তো অকালেই।
আমরা বিভিন্ন রকমের লাফ আবিষ্কার করেছিলাম। সোজা লাফ, উল্টা লাফ, ঘুরতে ঘুরতে লাফ, সোজা ডিগবাজি, উল্টা ডিগবাজি, সোজা ডাইভ, উল্টা ডাইভ- আরও কত কি! এমনকি আমাদের এই লাফালাফি ঠেকানোর জন্য ঘাটের পাশে বিভিন্ন ধরনের ডালপালা ফেলে রাখা হতো।
কঞ্চিসহ বাঁশ ফেলে রাখা হতো, যাতে করে আঘাতের ভয়ে আমরা অন্তত আর লাফ না দেই। আমরা সেগুলোকে সরিয়ে আবার লাফালাফি শুরু করতাম। আর এক পুকুর থেকে তাড়িয়ে দিলে অন্য পুকুরে গিয়ে লাফালাফি শুরু করতাম।
আমাদের চোখ একসময় রক্তবর্ণ ধারণ করতো। আর এটা দেখলেই মা বুঝে যাবে যে আমরা অনেকক্ষণ পুকুরে নেমে লাফালাফি করেছিলাম। তাই পুকুর থেকে উঠে ঘাটের পাড়ের দুর্বা ঘাসের ডগা তুলে গুচ্ছ করে সেটা দিয়ে চোখের উপর ঘঁষতাম, এতে নাকি লাল ভাবটা দ্রুত কমে যায়। আসলে যায় কিনা আমরা জানতাম না। কিন্তু মায়ের হাত থেকে বাঁচার একটা চেষ্টা আমরা করতাম।
এমনই একদিন লাফালাফি করতে গিয়ে ঘাট বরাবর ডাইভ দিয়ে ঘাটের নিচের দিকের সিঁড়িতে আঘাত পেলাম। মনে হলো, বেশ জোরেই লেগেছে। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে অন্যপাড়ের ঘাটের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। ওই পাড়ের কাছাকাছি যাওয়ার পর দেখি সবাই আমার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে। আমি তখনও বুঝিনি মাথার খুলি ফেটে গেছে আমার।
সবাই ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে গেলে আব্বা বললেন, “আমি ওর মাথায় সেলাই করাব না। ও বড় হয়ে যখন ওর এই দাগটা দেখবে, তখন বুঝবে কতোটা দুষ্টু ছিলো ও।”
এখনও প্রথম পরিচয়ের পর সবাই জানতে চায়। আমার কপালের ডান পাশের বিশাল এই ক্ষতটা কীসের? আমি তখন মুচকি হাসি।
আমার আট বছরের মেয়ে তাহিয়া। ছোটবেলা থেকেই তার পানির প্রতি মহা আসক্তি। গোসলে গিয়ে বালতির পানিতে ডুব দেওয়া থেকে শুরু করে সারাদিন সমুদ্রের পানিতে নেমে থাকা, সবই তার খুব পছন্দের কাজ। আর দুই বছরের ছেলের রায়ানেরও পানির প্রতি আসক্তি চোখে পড়ার মতো। যতক্ষণ ওরা গোসলখানায় থাকে, ততক্ষণ খুবই খুশি থাকে।
আর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেলে তাদের খুশির অন্ত থাকে না। বালির মধ্যে আঁকিবুকি, গর্ত করে ঝরনা তৈরি, বালিতে সারা শরীর ঢেকে ফেলা- সবই ওদের খেলার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, আমি যখন সমুদ্রের পানিতে নামি, তখন ওরাও আমার সাথে পানিতে নামতে চায়। আমি তখন রায়ানকে কাঁধে আর তাহিয়াকে হাতে ধরে পানিতে নেমে পড়ি।
আমরা এমন গভীর সমুদ্র পর্যন্ত যাই যে একবার একজন আমাদের পানিতে নামা দেখে হার্ট অ্যাটাক করতে বসেছিলেন। পরে আমরা পানি থেকে উঠে আসার পর উনি আমাদেরকে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। আমরা খুবই মনোযোগ দিয়ে এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম।
রায়ানের মাটি নিয়ে খেলার ব্যাপারটা আলাদা করে বলার প্রয়োজন বোধ করছি। ওকে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই মাটি খুঁজে বের করে তারপর সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞের মত নাড়াচাড়া করতে থাকে। সেটা সারা শরীরে মেখে একসময় উপরের দিকে ছুড়তে থাকে। আর সেটা তার গায়ে-মাথায় এসেই আবার পড়ে।
মাটি না পেলে বাগানের গাছের গোড়ায় দেওয়া কাঠের টুকরা নিয়ে খেলা শুরু করে। খেলা শেষে গায়ের পোশাক না ধুয়ে, তাকে গোসল না করিয়ে তার মা ঘরে ঢুকতে দেয়না। ইদানিং বাগানের গাছের জন্য আমাদের বাড়িওয়ালা ভাই মুরগির বিষ্ঠা নিয়ে এসেছেন। রায়ান সেই বিষ্ঠার স্তুপে উঠে পড়ে, তারপর সেটাকে মাটি বানিয়ে খেলা শুরু করে দেয়। মাটি হলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু বিষ্ঠা হওয়াতে তার মা বেজায় রাগ করেন। প্রায়ই আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার হুমকি দেন।
ইদানিং আমাদের বাসাটা আর মানুষের বাসা নেই। এটাকে চিড়িয়াখানা বলাই শ্রেয়। অবশ্য চিড়িয়া একটা আর বাকিদের মানুষই বলা যায়। কিন্তু চিড়িয়া রায়ান একাই সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। বাসার টিভি, মোবাইল, আইপ্যাড- সবই তার দখলে। এর বাইরে যেকোনো কিছু তার পছন্দ হয়ে গেলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করবে। আর সেটা না পাওয়া পর্যন্ত চিৎকার থামাবে না।
আর যদি কোনোকিছু তার কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যায়। তখন হাতের কাছে যাকেই পায়, তাকেই খামচি-কামড়-মাইর দেওয়া শুরু করে। আমাদের প্রত্যেকের মুখেই ওর দেওয়া খামচির দাগ বিদ্যমান। আর একটু জোর গলায় কথা বললেই একেবারে মুখ ভার করে ফেলবে। দেখলে মনে হবে, এক্ষুণি বুঝি কেঁদে দেবে।
অতিথি আসলে রায়ানের চেয়ে ভদ্র ছেলে আর একটাও নেই। তারপর অতিথির সাথে একটু সহজ হয়ে গেলে দুষ্টুমি শুরু করে। আমি সবসময়ই একটা ব্যাপার মানি, দুষ্টু বাচ্চারা মেধাবি হয়। কিন্তু নগর জীবনের হাজারও ব্যস্ততায় বাচ্চাদের দুষ্টুমি এখন আর আমাদের ভালো লাগে না।
গতানুগতিক আর দশটা বাচ্চা যেমন, নিজেরটা তেমন না হলে আমরা চমকে উঠি। কিন্তু একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটা বাচ্চাই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়। তাই তাদের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
প্রযুক্তির গতিময়তা আমাদেরকে দিনে দিনে অনুভূতিহীন যন্ত্রে পরিণত করছে। সবকিছুর জন্যই এখন অ্যাপ আছে। এমনকি বাচ্চার খাওয়া থেকে শুরু করে টিকা পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায় এইসব অ্যাপ দিয়ে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে, যেখানে মোবাইল আইপ্যাড ছাড়া জীবন একেবারেই অচল, সেখানে বাচ্চারা ধুলোবালি নিয়ে খেলছে, সমবয়সি বাচ্চা বা বড়দের সাথে খুঁনসুটি করছে- এটা বেশ ব্যতিক্রমই বলা চলে। তবে আমার মনে হয়, এগুলোর সবই একটা বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জরুরি।
আমরা প্রযুক্তির জঙ্গলে বসবাস করে যতটা পারছি প্রযুক্তি থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে। যাতে করে আমাদের বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। তাই সাত সমুদ্র তের নদীর এই পাড়ে এসেও যখন দেখি নতুন প্রজন্ম আমাদেরই মতো একইভাবে তাদের শৈশবের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত, তখন নিজের অজান্তেই নিজের শৈশবের রঙিন দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
পরিশেষে দুনিয়ার সকল বাচ্চা একটা বর্ণিল ও স্মৃতিময় শৈশব নিয়ে বেড়ে উঠুক- এটাই কামনা করছি। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটু চেষ্টা করি, তাহলেই এই পৃথিবী হয়ে উঠবে প্রত্যেকটা শিশুর জন্য বাসযোগ্য স্থান।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |