মানুষের আয়ের উৎস তার দুই খানা হাত। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ায় মাসিক আয়ের চাকা চালু রাখতে রোমা নারীরা বাধ্য হোন নিয়মিত সন্তান প্রসবে।
Published : 23 Feb 2017, 12:09 PM
উপরের শিরোনাম! তারপরের কথাগুলো খানিকটা অবাক করার মতোই। অবাক হতে পারেন। তবে পুরোপুরি অবাক হতে হলে আরও খানিকটা পড়তে হবে।
গত সপ্তাহে বলেছিলাম কেন এলাম ক্রোয়েশিয়া? গবেষণার কাজ। গবেষণা না ছাই! মার্সিডিজে চড়ে গরিবের দুঃখ দেখো। আর ঠোঁট গোল করে চুকচুক শব্দ করো।
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে জেনে নেই,যাযাবার এই রোমারা আসলে কারা? এরা আমার আপনার আত্মীয়। আই মিন,আত্মীয় হলেও হতে পারে। গবেষণা বলছে, রোমাদের আদি নিবাস ভারত। নির্দিষ্ট করে বললে উত্তর ভারত। প্রায় পনেরোশ' বছর আগে তারা কোন এক কারণে গৃহত্যাগী হয়। বেছে নেয় যাযাবরের জীবন। ইউরোপের আজকের রোমারা এখানে এসেছে প্রায় নয়শ' বছর আগে। তাদের আসার পথ পার্সিয়া, আর্মেনিয়া এবং বলকান অঞ্চল।
গোটা পৃথিবীতে রোমাদের সংখ্যা প্রায় ১২ মিলিয়ন। রোমনিয়া,বুলগেরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ রোমা। তুরস্কে আছে প্রায় ২ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন রোমা। আমেরিকাতে এদের সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়নের মত। ব্রাজিলে এদের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। এছাড়া সার্বিয়া,হাঙ্গেরি,স্লোভাকিয়া,রাশিয়াতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রোমারা।
পৃথিবীতে এরকম নির্যাতিত গোষ্ঠী আর ক'টা আছে- বলা মুশকিল। যেখানেই রোমারা গেছে সেখানেই- ‘নো স্বাগতম'। হয় দাসত্ব,নয় সোজা খুন। খোদ রোমানিয়াতেই এদের আছে পাঁচশ' বছরের দাসত্বের ইতিহাস। কী ইংল্যান্ড,কী সুইজারল্যান্ড- সবার হাতেই লেগে আছে রোমাদের রক্ত।
১৯৮০ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জোর করে রোমা নারীদের উপর গর্ভনিরোধ পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েছিলো। কারণ রোমা নারীদের সন্তান জন্মদান ক্ষমতা নাকি অনেক বেশি! অথচ আমি ছোটবেলায় সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ নেবার সময় জেনেছিলাম দরিদ্রের বিনোদন মানেই সন্তান জন্মদান।
রোমাদের ওপর চালানো এই নির্যাতনের ফলাফল হয়েছে খুবই ভয়াবহ। কয়েকশ' বছরের নির্যাতনের কারণে রোমারা কাউকেই আর বিশ্বাস করে না। তাদের নিজেদের মতো করে থাকতে চাওয়াটাই এখন তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। অশিক্ষা,চিকিৎসা সমস্যা,খাদ্যাভাব,কুসংস্কার- এসবের সঙ্গেই তাদের নিত্য সহবাস।
ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় রোমাদের গ্রামে আমি গিয়েছিলাম। একটা গ্রামের তিন-চারটা নাম। ডোনসা ভিরেটনা,গোরনজে ভারডেনস্লো ইত্যাদি। রোমাদের মধ্যে যারা ধনী তারা এই গ্রামকে এক নামে ডাকে। সবচেয়ে বড়লোকদের চাইতে একটু গরিবরা ডাকে আরেক নামে। আবার সবচেয়ে গরিবরা এই গ্রামকে ডাকে বড়লোকদের দেওয়া নামে।
সরকারি বেনিফিট নিতে বাচ্চা জন্মদানে বাধ্য হওয়া। কারণ ক্রোয়েশিয়াতে রোমা'রা অচ্ছুৎ। তাদের জন্য কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। আছে শুধু নির্দিষ্ট হারে বেনিফিট। এই ছোট্ট এক গ্রামে একসাথে আমি যতো গর্ভবতী শিশু আর নারী দেখেছি,আমার পিতা প্রদত্ত জন্মেও এত গর্ভবতী আমি দেখি নাই।
রোমাদের মাঝে দেখলাম ১০ বছরের মেয়ে শিশু গর্ভবতী। এক নারীর সাথে কথা বললাম। জানলাম তার প্রথম সন্তান জন্মের সময় বয়স ছিলো ১২। এই পর্যন্ত প্রায় ১৪ বার গর্ভপাতের মুখোমুখি হয়েছেন।
বিকাল বেলা দেখলাম রিক্সাভ্যানে করে কেউ কেউ বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে বের হোন (ভিডিও দেখুন)। এবার বুঝেন বাচ্চাদের সংখ্যা!
তো এখানকার রোমাদের মূল পেশাটা কী? স্থানীয় ক্রোয়াটরা বলে- সন্তান জন্মদান। যার যতো সন্তান, তার মাথাপিছু ততো সরকারি আয়। আর পাশাপাশি চুরি। আশেপাশের ক্রোয়াটদের দামী কিছু চুরি হয়েছে? তবে চলো রোমাদের গ্রামে। সেখানে কিছু পয়সা দিয়ে চুরি যাওয়া নিজের মাল আবার নিজেকে দ্বিতীয়বার কিনতে হয়।
ক্রোয়েশিয়ান সরকারও বেশ অদ্ভুত। এই সব রোমাদের দেখিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো ভিক্ষা চাইছে কিন্তু আসল কাজে লবডংকা। খোলা টয়লেট, নোংরা খাবার পানির উৎস! ইউরোপের কোথাও এমন জীবন দেখতে চান? তাহলে সোজা রোমাদের গ্রাম!
তো আমি যতোই এদের সাথে খাতির করতে চাই, এরা ততই আমার দলের কৃষ্ণাঙ্গদের পেছন ভাগে। এক রোমা শিশুর নাম ভ্যালেন্টিনা। জীবনেও নাকি সে আফ্রিকান দেখে নাই। আমার ডাটা মেইট ডিওজিলডার বাড়ি অ্যাঙ্গোলা।
ভেলেন্টিনা কিছুক্ষণ পরপরই আমাদের কাছে আসে। ওর আগ্রহের বিষয় ডিওজিলডার গায়ের রঙ। এসেই ও ওর হাতে ঘসে। ওর ধারণা, মানুষ এমন কালো হতেই পারে না। নিশ্চয়ই ডিও'র গায়ে কালো রঙ করা। আর ভ্যালেন্টিনা চায় ঘষে ঘষে সেই রঙ ওঠাতে।
এ তো গেলো শিশুদের কৃষ্ণাঙ্গ ভাবনা। এক কিশোরীর নাম মারিন্টিনা। তার ধারণা,আমাদের দলের কালোরা ফুটবল খেলোয়ার। সে আবার প্রতিদিনই দলের এক কালো ছেলের জন্য ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে – ‘আই লাভ ইউ, ‘ভুলো না আমায়', টাইপ পত্র নিয়ে হাজির হতো।
কথা হলো চল্লিশের আশেপাশের এক নারীর সাথে। নাম ফ্লিও। দেখে মনে হয় বয়স ৬০। গর্ভধারণের ভারে অল্পতেই বুড়িয়ে গেছেন। এই ভদ্রমহিলা এই গ্রামে এসেছেন আট বছর বয়সে। রোমারা সাধারণত ১২ বছর বয়সেই সঙ্গী বেছে নিয়ে আলাদা জীবন শুরু করে। তো সেই মহিলা অনেক কসরত করেও ঠিক কতবার গর্ভধারণ করেছেন,কতবার গর্ভপাত করেছেন মনে করতে পারলেন না। এতটুকু বলতে পারলেন,ওনার পাঁচ শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়েছে নানা রকম শারীরিক জটিলতায়।
প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই আমি গিয়েছিলাম। সবচেয়ে গরিব পাড়ার বড়লোকের গল্প শোনাই। ভদ্রলোকের বাড়ি বলতে একটা রুম। সেই রুমকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বলে রাখা ভালো,ইউরোপে সাধারণত রিলেটিভ পোভার্টি মডেল ফলো করা হয়।
সেই ভদ্রলোক ভাঙ্গারির ব্যবসা করেন। ভাঙ্গারি মানে হলো,ফেলে দেওয়া ধাতব লোহা,টিনের ব্যবসা। প্রতিবেশিদের মতে,এইসব ভাঙ্গারি-ভুঙ্গারি ব্যবসা কিছুই না। জাস্ট ভুজুং ভাজুং। এই লোকের মাদকের ব্যবসা। তবে তার এই ‘শুরুর আগেই শেষ' ঘরে কী নাই? ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি,দুইটা ফ্রিজ। গোটা গ্রামে সবচেয়ে ধনী পরিবারের ঘরেও ডিশ ওয়াশার নাই,কিন্তু সেই ভদ্রলোকের ঘরে আছে। কিন্তু সেই পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে না নিয়মিত। খুবই নোংরা পরিবেশে বেড়ে উঠছে। এমনই বাস্তবতা এই গ্রামের।
তবে এত সমস্যার পরও মানুষের স্বপ্ন দেখা থেমে নাই। একটা ১৬ বছরের মেয়ের সাথে কথা হলো। নাম দিলাম স্বপ্না। গ্রামের প্রথম সারির সুন্দরী। এখনও সিঙ্গেল। কতো ছেলেদের ভীড় তার আশেপাশে। এই মেয়ের কিন্তু স্বপ্ন অন্য উচ্চতার।
গোটা গ্রামের সেই একমাত্র মানুষ যে জার্মান ভাষা জানে। ইংলিশও চমৎকার। তার স্বপ্ন ফ্যাশন ডিজাইনার হবার। যে করে হোক,তার স্বপ্ন সে সফল করবেই।
স্বপ্নার বাড়িতে গেলাম। গোটা ঘর জুড়েই হাতে আঁকা অসংখ্য ছবি। জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর- সবই স্বপ্নার নিজের বানানো। এই মেয়ে যে কিছুদিন পরে ইউরোপ কাঁপানো ফ্যাশন ডিজাইনার হবে-তা নিশ্চিত। আমি আর দেরি করলাম না। ফেসবুকে আমরা দুজন এখন বন্ধু।
অনেক মানুষের মাঝে খুঁজে পেলাম এক রসিক রাজকে। ভদ্রলোক সারাক্ষণই হাসিখুশি। হাতে ক্যামেরা দেখে ছবি তুলতে চাইলেন। প্রায় ২০টার মতো ছবি তুললাম। এখানেই শেষ না। ছবি তুলতে হবে ওনার পালন করা শুকরের। আমি যতোই শুকরকে দূর থেকে ফোকাস করি,উনি আমাকে তত কাছে ঠেলেন। ঠেলতে ঠেলতে প্রায় শুকরের কোলে উঠান আর কি!
সেই শুকর দর্শন শেষে নিজের গায়ে আবিষ্কার করলাম,ইউরোপের জঘন্য পোকা 'টিকর'। এই ঘরানার কোন কোন পোকা পৌঁছুতে পারে মস্তিষ্কের ভেতর। হতে পারে মরণের কারণ। যদিও সেই যাত্রায় তিনদিন জ্বরে ভুগে বেঁচে গিয়েছিলাম।
কেন পারেনি? কেন সরকারি বেনিফিট রোমাদের কাজে আসছে না? কঠিন প্রশ্ন কিন্তু উত্তর সোজা। উত্তরটা ধার করছি অর্থনীতিবিদ স্টিভেন ডি লেভিট-এর কাছ থেকে।
কেন বেনিফিট মাঝে মাঝে কাজ করে না? এর উত্তরে তিনি উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন নিজের মেয়েকে।
উনার ছোট্ট মেয়ে। আবার অতো ছোট্টও সে নয়। মেয়ের রেগুলার টয়লেট ব্যবহার করা উচিত এই বয়সে। কিন্তু এখনো সে বাচ্চাদের পটি ব্যবহার করছে। কিছুতেই বড়দের টয়লেটে যাবে না। লেভিট তার মেয়েকে একটা অফার দিলেন। যতোবার মেয়ে বড়দের টয়লেটে যাবে ততোবার সে একটা করে চকোলেট বার পাবে। লেভিট খেয়াল করলেন- এই অফার দেয়ার পর থেকে উনার মেয়ে প্রায় কিছুক্ষণ পরপরই টয়লেটে যাচ্ছে। আর বাবার কাছ থেকে চকোলেট বার আদায় করে নিচ্ছে।
রাতের বেলা মেয়ের রুমে গিয়ে লেভিট আবিষ্কার করলেন চকোলেট বারের গুদাম। সরকারি বেনিফিটের উপর বেঁচে থাকা মানুষদের অবস্থা অনেকটাই লেভিট-এর বাচ্চা মেয়ের মতো। বোঝা গেছে ব্যাপারটা?
গত প্রায় কয়েক দশক ধরেই ইউরোপের রোমা গ্রামে এই দুষ্ট চক্র চলমান। সুদর্শন রাজনীতিবিদ, আমাদের মতো ধামাধরা রির্সাচার সবার লাভের গুড় জোগান দিচ্ছে এই রোমাদের মতো মানুষেরা।
তবে আশার কথা রোমাদের সেই গ্রামে স্বপ্নার মতো মেয়েরা জন্মাচ্ছে। সেই স্বপ্না এক থেকে এক লক্ষ হবে। রোমাদের আগামীকাল হবে অনেক সুন্দর।
লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন
লেখকের ই-মেইল: [email protected]
ফটো তুলেছেন: মিশায়েলা কুটরোভিচ এবং লেখক নিজে
রিনভী তুষারের আরও লেখা