বিদেশ ভালো: বাঙালি মাছের পদ্যে জার্মানি গদ্যময়

‘মীনাক্ষোভাকুল কুবলয়’- মানে ‘মাছের তাড়ণে যে পদ্ম কাঁপিতেছে’।

রিনভী তুষার,জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2016, 12:17 PM
Updated : 21 Nov 2016, 01:40 PM

এটা লিখেছিলাম আগে। এবার লিখলাম ‘মীনাক্ষোভাকুল জার্মানালয়’ অর্থাৎ 'মাছের তাড়নে জার্মান কাঁপছে'।

এবারের লেখায় শুধু আদা-রসুন-পেঁয়াজের গন্ধ। গন্ধ ভালো না লাগলে নাক চেপে ধরে পড়তে পারেন।

আমি যখন ছোটবেলায় জার্মানি যেতে চেয়েছিলাম, তখন আমার বাবা ছড়া কেটে বলেছিলেন, ‘রুটি খাবি-খা,জার্মানি যাবি যা..।’

এখন বুঝি এই রুটি খেতে বলার রহস্য।

কে বলে জার্মানি'র ইতিহাস যুদ্ধের! জার্মানি'র ইতিহাস রুটির ইতিহাস। এই ইতিহাসের বয়স ছয় হাজার বছর। তিনশ রকমেরও বেশি রুটি আছে এই দেশে। আছে রুটির জাদুঘর।

রুটির এই দেশে অনেক ক্ষমতা। যেমন সন্ধ্যাবেলার খাওয়ার সময়ের জন্য বরাদ্দ করা একটা শব্দের নাম ‘আবেন্ড ব্রোট’। মানে সন্ধ্যাবেলার রুটি। আমাদের আছে ‘সন্ধ্যা তারা’। এদের ‘সন্ধ্যা রুটি’।

তবে এদের রুটির নাম বড়ই অদ্ভুত। একটার নাম ‘ব্রোয়েটশেন’। মানে 'ছোট ব্রেড'। এরকম অনেক ছোট ব্রেডকেই এরা ডাকে ‘ব্রোয়েটশেন’ বলে।

এতো গেল রুটি'র কথা। জার্মানি বিয়ার খাওয়া জাতি হিসাবে তিন নম্বর। বাভারিয়া রাজ্যে তো আবার বিয়ারকে খাবার হিসাবে ধরা হয়! ভাবেন একবার। কেউ জানতে চাইলো,দুপুরে কি দিয়ে ভাত খেয়েছেন?

আপনি বললেন, বিয়ারের ঝোল।

এতো যে রুটি'র গুণ গাইলাম, কিন্তু জার্মান রান্না'র স্বাদ আর ডুমুরের ঝোল একই বিষয়। এদের রান্নাবান্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের ডালের মতো। তবে এসব নিয়ে এদের কোন পেটব্যথা নেই। এরা শুধু রুটির উপরই বাঁচে।

তো তেমনই এক রুটি খাওয়া সকালের দুপুরে আমি গেলাম মেনসায়। আমাদের ক্যান্টিনের শেফ আমার পাতে হাসিমুখে তুলে দিলো দুইটা সেদ্ধ আপেল। সাথে সুজির সুরুয়া টাইপ কিছু। আমি ভাবলাম, আরো কিছু দেবে।

দিল শুধু গাল ভরা হাসি। আমার এই প্রথম জার্মান খাদ্যগুণে নেত্র কোণায় জলে চিক চিক।

রাগে,দু:খে,শোকে মনে পড়ে গেলো শ্রীহর্ষ'র শ্লোক- ''ওগ গরভত্তা রম্ভঅপত্তা,গাইকঘিত্তা দুগ্ধসজুত্তা। মোইণিমচ্ছা,ণালিচগচ্ছা,দিজ্জই কন্তা খা পুণবন্তা।"

আহ, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম !

আমার বন্ধু থমাস গোগ্রাসে গিলেই যাচ্ছে। বিরতিহীন হাত। মুখে আহ,উহু!

আমি থমাস'রে বললাম, নে ব্যাটা এটাও গেল।

ও বললো, আর ইউ শিওর?

ইচ্ছা করছিলো, ব্যাটা শেফকে ধরে ওর দুই গালে দুইটা আপেল ঠেসে দেই।

আমার রাগ আরও বাড়লো থমাসের কথায়। ব্যাটা বলে কিনা, 'দিস সেদ্ধ আপেল ইস দা বেস্ট ফুড,ইউ বাঙ্গাল ওনলি ইট রাইস।'

থমাস'রে বললাম,'জানস ব্যাটা, বাঙালি কতো বছর ধরে ভাত খায়?

ও বললো, কতো?

আমি বললাম, জাস্ট গেস কর।

ও বললো, একশ-দুইশ বছর।

আমি বললাম, চার হাজার পাঁচশ বছরের ঐতিহ্য হলো বাঙালির ভাত খাওয়া। আমরা এসব গাছ-গাছালি সেদ্ধ করে খাই না।

তিতো,বাটা,ছেঁচকি,ভাজা,পোড়া,পুর,চচ্চরি,ঘণ্ট,সেদ্ধ,ডাল,ঝাল,ঝোল,অম্বল,টক,রসা,কণ্ঠা,পাতুরি,মালাইকারী,ঝাটী, পৈঠা, ধোকা, শড়শড়ি, কালিয়া,দোলমা,বাগাড়- এত পদের রান্নার নাম তোরা ইহজনমে শুনেছিস?

রাগ কমালাম। বিপ্লবের তেজ বাড়ালাম। সেদিন থেকে আমার রান্নার বিপ্লব শুরু। শুরু করলাম ভাত,আলু ভর্তা,ডাল আর ডিমভাজি দিয়ে। দেখলাম বিয়ে করার মতো রান্না আমাকে দিয়ে হচ্ছে।

যে দিনকাল পড়েছে,জীবনসঙ্গীকে বিশ্বাস করা যায়,কিন্তু তার হাতের রান্নাকে নয়। আমার রান্নার সুবাস চারদিকে ছড়াতেই আমার অনেক জার্মান মুরিদ জুটে গেলো।

একদিনের ঘটনা। আমার মুরিদরা হাজির। রান্না'র জলসা হবে। আমি ততোদিনে প্রপার রান্না জানা পীর। আমি এখন আর রাঁধি না। কৈ মাছের তেলে কৈ ভাজি। রান্না সুপারভাইজ করি। মুরিদরা আসে। তাদের বলি, এভাবে আলু, পেঁয়াজ, সবজি কাটো। এভাবে মাছ,মাংস। আমি রুমে যাচ্ছি। কাটাকাটি শেষ হলে ডাকবা।

তারা কাটাকুটি শেষ করে ডাকে। আমি তারপর রান্না বসাই। রান্না বসিয়ে বলে দেই কিছুক্ষণ পর পর নাড়তে। আমি আমার রুমে ফেরত যাই। ওরা রান্না শেষ হলে কিচেন থেকে ফোন করে। আমি আসি আর খাই। ব্যস সহজ মেথডে বাঙালি রান্না।

একদিন অনেক মুরিদের জন্য খিচুড়ি রাঁধতে গিয়ে খিচুড়ি পুড়িয়ে ফেললাম। এখন কী করা! জার্মানরা তো পোড়া খাবার খাবে না।

তার উপর চাল-ডাল সবজি সব ওদের কিনে আনা। আমি শুধু ইন্ডিয়ান এনটিপিসি'র মতো কনসালটেন্ট (এনটিপিসি যারা আমাদের সুন্দরবনের মহাসর্বনাশ ডেকে আনার জন্য জোটবদ্ধ)।

তো ওদের পাতে খিচুড়ি দেয়া মাত্র ওরা বললো, এটা তো পোড়া। আমরা পোড়া খাবার খাই না।

আমি বললাম, নাহ এটা স্মোকি খিচুড়ি। স্মোকি ফিশের মতো স্মোকি খিচুড়ি।

ওরা বললো, বাহ পারফেক্টলি কুকড। আর একটু পুড়লেই আর খাওয়া যেতো না।

তো আমার এমন বাহারি রান্না'র ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো গোটা ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও একবার ঘটনাবশে আমার রান্না খেয়ে ফেললেন। প্রস্তাব করলেন বাঙালি খাবার রাঁধতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে। আমিও রাজী হয়ে গেলাম।

আমার শর্ত ছিলো রান্না বিক্রি করে পাওনা টাকার একটা অংশ দিয়ে আমি রেফিউজিদের জন্য খাবার রান্না করবো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের একটা শহরেই আছে রেফিউজিদের শেল্টার সেন্টার। আমার ভিসি রাজী হলেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়েরও শর্ত ছিলো। আমাকে পাবলিকলি রান্না করার আগে দুই-দুইটা টিকা নিতে হবে। নিয়েছিলামও।

মাসব্যাপী রান্না উৎসব ক্যাম্পাসে। ভিন্ন দেশ ভিন্ন রান্না। দিকে দিকে প্রচার হলো। আমার মাছ-ভাতের রেসিপিতে বেশি ক্লিক পড়লো। তাই আলাদা করে মিঠা পানির মাছ অর্ডার করতে হলো। বাংলাদেশের মাছের এখানে অনেক দাম। আর পাওয়াও যায় না। তাই তেলাপিয়াই সই,সাথে স্যামন।

প্রায় তিনশ জনের জন্য রান্না করতে হলো। প্রথম দিন রান্না করলাম আলু,পেঁপে, ঝিঙা'র নিরামিষ,ডিম ভাজা,পটল ভাজা,পাতলা ডাল আর মোটা চালের ভাত। দ্বিতীয় দিন ভাত-ভাজি (বাঙালি স্টাইলে চায়নিজ ফ্রায়েড রাইস),আলু ভর্তা,বেগুন ভাজা,ডিম ভুনা।

আলুতে দিলাম শুকনা মরিচ। শুকনা মরিচ টালতে গিয়ে দেখি আমার কিচেনের সব স্টাফ কাশতে কাশতে দৌড়ে পালাচ্ছে। আর আলু ভর্তা খেয়ে পাশের ওল্ড হোমের বুড়া-বুড়িরা আর জীবনেও ঝাল না খাওয়া জার্মানরা হই হই করে উঠলো।

এক বুড়ি খুশি হয়ে আমাকে খুঁজে বের করলো। আমার হাতে ২০ ইউরোর একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললো, সে কোনদিনও এমন মজার রান্না খায়নি। কিন্তু তার বুড়া বললো উল্টো কথা,'দু মুস আউফপাসেন' (মানে তোমার একটু খেয়াল করা উচিত ছিলো), এতো ঝাল দিয়ো না।

ডেজার্ট হিসাবে বানালাম পায়েস,স্পঞ্জ রসগোল্লা। সাথে দিলাম স্পঞ্জ রসগোল্লা'র ইতিহাস জুড়ে। জার্মানরা জানলো, তারা পাচ্ছে ১৮৬৮-তে বাগবাজারে প্রথম তৈরি হওয়া মিষ্টির স্বাদ। দু'দিন মোটামুটি ভালোই বিক্রি হলো।

 কিন্তু তৃতীয় দিন আমাদের সব প্রেডিকশন ছাড়িয়ে গেলো। বাঙালি ঘরানায় মাছের দো-পেঁয়াজো রান্না। টমেটো,শসা,সরিষার তেল,ধনে পাতা দিয়ে সালাদ। ঘন ডাল। বাসমতি চালের ভাত।

বাঙলা ঘরানার মাছের ঝোল গড়িয়ে গেলো গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায়। দুপুরে খাবারের এতো কাটতি দেখে সন্ধ্যাবেলার জন্য আমাদের অগ্রিম অর্ডার নিতে হলো। প্রথমবারের মতো ক্যান্টিনের চুলা সন্ধ্যাবেলাতেও জ্বালাতে হলো। দুই বেলা রান্না করতে হলো। এক্সট্রা মাছ কিনে আনতে হলো। সাথে মুসুরির ডাল,শসা,টমেটো আর ধনে পাতা।

আমার জার্মান বন্ধুরা অর্ডার কনর্ফাম করতে আমাকে রিকোয়েস্ট করে টেক্সট করতে লাগলো। সন্ধ্যাবেলা ক্যান্টিনে খুব একটা খাবার বিক্রি হতো না। কারণ জার্মানরা সকালে খায় সম্রাটের মতো। দুপুরে রাজার মতো আর সন্ধ্যায় ফকিরের মতো।

তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম এক কেনিয়ান স্টুডেন্টর কথা শুনে। ও বলেছিলো, ও ওর জীবনে কোনদিনও এতো মজার মাছ রান্না খায়নি। ওর আবার প্রায় ২০ বছরের জীবন। আমি বুঝলাম না এটা কি ওর বয়সের ব্যর্থতা নাকি আমার রান্নার সফলতা।

তবে বাঙালি আর মাছের সম্পর্ক! ধারণা করা হয় ধর্ম রক্ষায় স্মার্ত রঘুনন্দন নিদান দিয়েছিলেন, হিন্দুরা এমনকি ব্রাহ্মণরাও মাছ খেতে পারবে। এই মাছ নিয়েই প্রবাদ,“তেলে-জলে কাঁচা,মাছে-ভাতে মেচা”।

কৌতুক আছে, 'বঙ্গাল ডুবা খানে পে'। অবৈধ বাতাসবান্ধব জেনেও ভাজা-পোড়া খাওয়াতে কোন কমতি নেই। ভাজা-পোড়ার ইতিহাস মহার্ঘসমই।

ইংরেজ আমলের ঘটনা। ভাজা-পোড়ার সঙ্গে মুড়ি আর কাঁচা মরিচ খাচ্ছিলেন এক বাঙালি। সেটা দেখে এক ইংরেজ সাহেব তাকে জেলে পাঠিয়ে দিলেন। ইংরেজ সাহেবের নাকি মনে হয়েছিল, ওই খাবারের পর উৎপন্ন এলোমেলো বাতাসে উড়ে যাবে তার রেজিমেন্ট।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাধুপুরুষ হয়েও ভাজা-পোড়া খাবার লোভ সামলাতে পারেননি। সুভাষচন্দ্র বসু'র নামে তো কলকাতায় দোকানই আছে  নেতাজির তেলেভাজা।

এতোসব ভেরেণ্ডা ভাজার কারণ হলো, মাছ-ভাত-সবজির পর অবৈধ বাতাসবান্ধব ভাজা-পোড়াটা জার্মানদের খাওয়াবার প্লান করছি। ব্যাটারা এবার বুঝবা, 'কতো ভাজায় কতো অম্বল,হাতে লোটা সাথে ছেড়া কম্বল'।

সবার দোয়া প্রার্থী।

লেখক: গবেষণা এবং লেখালেখির চেষ্টা করেন।

ছবি কৃতজ্ঞতা: রিনভী তুষার, অ্যালেক্স ও ক্লাউডিয়া

ইমেইল: kurchiphool@gmail.com