তা না হলে এয়ারপোর্টময় নিজের মালামাল নিজেরই বহন করতে হবে, কোন ট্রলি পাওয়া যাবে না। কারণ একটা এক ইউরোর কয়েন দিয়ে গোত্তা দেওয়ার পর একটা ট্রলি অনেকগুলি ট্রলি থেকে আলাদা হবে। আর যেহেতু মানুষ মাত্র পয়সা ভালবাসে তাই সে ইউরোর লোভে নির্দিষ্ট স্থানে ট্রলিটা রেখে আরেকখানা ট্রলির কি বা চাবি দিয়ে গোত্তা দিয়ে ইউরোটা উদ্ধার করবে।
এটাই চমৎকারী নিয়ম। গোটা জার্মানির কোথাও যত্রতত্র ট্রলি ঘোরাফেরা করে না। এদের ট্রলিরাও 'মানুষ'। আই মিন জর্মন মানুষ।
তারপর যখন চিঠি খাওয়ার পরও ট্যাক্স দেই নাই এবং বিপদ বুঝে যখন ট্যাক্স দিতে গেছি ততদিনে ‘সল' মানে কাস্টমস আমার ট্যাক্স না দেওয়ার কেইসটি বিক্রি করে দিয়েছে একটা প্রাইভেট কোম্পানির কাছে। যাদের ধ্যান এবং জ্ঞান পয়সা উসুল করা ।
এরা আবার আমার বকেয়ার উপর জরিমানা হিসাবে প্রতিদিন যোগ করেছে প্রায় ৫৪ সেন্টস'র মতো। এসব দেখে আমার তখন ত্রাহি মধুসূদন টু মাইকেল জ্যাকসন অবস্থা। আমিও কম যাইনা, ভাবলাম দোষ চাপাই ফেডেক্স কোম্পানি'র ঘাড়ে। কারণ তারা তো জিনিসটা ডেলিভারির সময় আমার কাছে ট্যাক্সের ব্যাপারটা বলতে পারতো, তাই না!
গেলাম 'কাস্টমস বাবা'র দরবারে। মাথা ঠুকে, পা ঠুকে, নানা রকম কসরত এবং খানিকটা ভরতনাট্যম করে কাস্টমসকে সশরীরে গিয়ে অনেক বোঝালাম...।
সেখানে দায়িত্বরত ভদ্রলোক আমার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, যাহ্ এই বুঝি বুঝে গেলো বাছাধন!
সবশেষে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি আমাকে বললেন- "সবই তো শুনলাম। তোমার সমস্যাটাও বুঝলাম। কিন্তু যদি আর কিছুক্ষণ আগে ট্যাক্সটা পে করে দিতে তাহলেও অন্তত কিছু সেন্টস কম জরিমানা হতো।"
যাই হোক সেদিন ৩৪ ইউেরো দামের জিনিসের জন্য ৬৪ দশমিক ৮৪ ইউরো ট্যাক্স, প্রসেসিং ফি এবং জরিমানা শোধ করে যেই জ্ঞান অর্জন করলাম তাহা হলো- জর্মন দেশের অফিসের টেবিলের যেহেতু সামনে কোন ফাঁকা নাই তাই টেবিলের তল দিয়ে কিছু হয় না।
মনকে সান্তনা দিলাম-পয়সা হাতের ময়লা কিন্তু জ্ঞান তো চায়নিজ চিজ। হোক না আক্কেল সেলামি তবু জ্ঞান তো অর্জন করলাম।
নিজের বেয়াক্কেলির গল্প বাদ। একটু রোমান্টিক হই। আসেন জর্মন দেশের রমণীদের নিয়ে একটু গল্প করি। ইউরোপে প্রবেশের পূর্বে আমার বহুবছর ধরে জর্মনবাসিনী এক বান্ধবীর কাছ থেকে আমি খানিকটা কৌশলে খানিকটা লজ্জায় জর্মন মেয়েদের এশিয়ান ছেলেদের বিষয়ে.. আই মিন বুঝতেই পারছেন.. জেনে নিয়েছিলাম।
তো আমার বান্ধবী বলেছিল- শোন তুমি হলা টিডিএইচ। মানে টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম। তোমার হবে।
আমার এই 'হবে' শুনেই মনে হয়েছিলো আমি জর্মন দেশে হেলেদুলে প্লেন থেকে নামবো আর দুপাশ থেকে জর্মন ব্লন্ড রমণীরা আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। আবার কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ছুটে আসবে আমার দিকে।
তো জর্মনে সবসময়ই আমি আমার সাথে ‘আমার হবে‘ ফিলিংস নিয়ে চলাফেরা করতাম। প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মেনসা' মানে ক্যান্টিনে খাচ্ছি। এক জর্মন তরুণী ব্লন্ড কিন্তু ড্রেডলক। আয়তনয়না। আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে ঠিক আমার সামনের চেয়ারে বসে পরলো ।
আমি তো আগেই জানি 'আমার হবে'.. সো, আমিও বেশ নড়চড়ে.. উঠার আগেই তরুণীর মা-বাবা আমার পাশের চেয়ারে বসে পরলেন। তরুণী আমার নাম জানতে চাইলো। নাম নিয়ে পরলাম মহা মসিবতে । আমাদের অনেকেরই ডাক নাম পাসপোর্টে সারনেইম বা বংশগত নামের জায়গা দখল করে আছে। আমারও তাই।
'সুম্যান' মানে তার দাদা-পরদাদা জুতার কারবারি ছিলো। আমি তারে 'হবে হবে ফিলিংস' নিয়ে বললাম - তোমায় আমি নাম দিলাম ‘সুমন'। এটা শুনে মোটামুটি সে খেঁকিয়ে উঠলো ।
জর্মন আর ইংলিশে সে যা বললো তার মোটমুটি মানে দাঁড়ালো- ‘খ্যাতা পুড়ি ব্যাটা তোর সুমনের। আমারে এই নামে ডাকবা না। আমার বাপ-দাদার পেশা ধরে আমারে ডাকবা কেন?' ঝাড়ি খেয়ে আমার 'টি' এবং 'এইচ' গেল উড়ে। আমি ডি মানে ডার্ক হয়ে পরে রইলাম। সে যাত্রায় আমার আর হলো না।
লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন
ছবি কৃতজ্ঞতা: রিনভী তুষার
ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com