গত সপ্তাহে এক বিদেশি বন্ধুর মেসেজ এলো, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- 'তোমার দেশের হিন্দুদের উপর হামলার খবর দেখলাম বিবিসি'তে। যা ঘটছে তা জেনে খুবই খারাপ লাগছে। আশা করি, তোমার আত্মীয়-স্বজনরা আক্রান্ত হননি।'
Published : 14 Nov 2016, 05:45 PM
মেসেজটা পড়ে লজ্জায় মাথাটা হেট হয়ে গেলো। যে বাংলাদেশের পরিচয় পাট, চা আর সৌন্দর্য দিয়ে, গৌরব করার মতো এক ইতিহাস দিয়ে, ক্রিকেটের অর্জন দিয়ে- সেই বাংলাদেশ আজ জঙ্গি হামলা, নাস্তিক হত্যা দিয়ে বিশ্বে শিরোনাম হয়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দিয়ে আলোচনায় আসে।
আমরা যারা দেশের বাইরে আছি তাদের জন্য এই ঘটনাগুলো যে কত বেদনার, কত লজ্জার তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে উন্নত দেশগুলোর এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি দেখে মনে হয় আমরা যেন সবাই একেকজন সম্ভাব্য হামলাকারী। আর নাম যদি হয় 'মুসলিম' তাহলে তো কথাই নেই।
অতিরিক্ত সতর্কতা নিয়ে চেক করা, ইন্টারভিউ নেয়া, এয়ারপোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখার মতো ভোগান্তি নিয়মিতই পোহাতে হয় প্রবাসীদের।
সে-ই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশের ভালো-মন্দে সবসময় প্রবাসীরা পাশে থেকেছেন।
নাসিরনগরে হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন প্রবাসীরা। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় প্রবাসীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। ৬ নভেম্বর লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে একটি সমাবেশ হয়।
'কনশাস ইয়ুথ ভলান্টিয়ার্স নেটওয়ার্ক' এর উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে আসা সবার হাতের প্লাকার্ডের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। দেশ থেকে হাজারো মাইল দূরে থাকলেও তারা সবাই বাংলাদেশে চলমান হামলার ঘটনাগুলোতে উদ্বিগ্ন।
নভেম্বরের হিম শীতল ঠাণ্ডার মধ্যে প্লাকার্ড আর মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে যেন তারা নাসিরনগরের ঘরপোড়া মানুষগুলোর কষ্টের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন সেদিন। নাসিরনগরের হিন্দু পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য লন্ডন প্রবাসী বিভিন্ন সংগঠনের অন্তত ৫ টি উদ্যোগের কথা আমার নজরে এসেছে।
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ, আক্রান্তদের আর্থিক সহায়তা করার জন্য চ্যারিটি সংগীতানুষ্ঠান, এমনকি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর যুক্তরাজ্য কার্যালয়ে গিয়ে সাহায্য চেয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছে একটি প্রতিনিধি দল। দেশে ফেলে আসা আত্মীয়-স্বজন-পরিজনদের নিরাপত্তা চিন্তায় উদ্বিগ্ন সবাই।
অনেককেই বলতে শুনি- থাকেন বিদেশে, দেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর এতো দরকার কী?
তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে মন চায় না। মনে মনে বলি, ভাই তুমিও যাও না বিদেশে। দেখবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের জন্য মন কতটা পোড়ে! কেউ হয়তো প্রকাশ করে আর কেউ করে না। কেউ সাহস নিয়ে প্রতিবাদী হয় আর কেউবা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কিন্তু দেশের খারাপ খবরে মন কাঁদে সবারই। নাসিরনগরে হামলার পর ইনবক্সে একের পর এক হামলার খবরের লিংক পাঠিয়ে যাচ্ছিলেন অমর'দা আর সুজিত'দা। তাদের অসহায় নিরব আর্তনাদ আমি বুঝতে পারছিলাম। তারা চাচ্ছিলেন যেন আমিও প্রতিবাদ করি। বাকি সবাইও যেন প্রতিবাদ করে!
দুজনেই থাকেন লিডস শহরে। ব্যবসায়ী, পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের এক কোণায় ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনা তাদের চোখ এড়ায়নি। তাদের মতো করেই তারা নিরবে জনমত তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন তরুণকে সাথে নিয়ে অলি ভাই তৈরি করেছেন 'কনশাস ইয়ুথ ভলান্টিয়ার্স নেটওয়ার্ক' নামে একটি সংগঠন।
নাসিরনগরের ঘটনার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন, আক্রান্তদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যে একটি চ্যারিটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করতে।
প্রবাসে এমন অমর, সুজিত আর অলিদের সংখ্যা অসংখ্য। আবার মুদ্রার ওপিঠে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও কমতি নেই এদেশে। সংখ্যার বিচারে তারাই হয়তো এগিয়ে যারা যুক্তরাজ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় তৎপর কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে নিরব।
আরেকটা ঘটনা বলি আপনাদের। নাসিরনগরে হামলার প্রতিবাদে ফেইসবুকে আমি একটি লাইভ ভিডিও দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই বার্মিংহাম থেকে একজন সাংবাদিকের ফোন পেলাম। আমি ভাবলাম হয়তো উনিও সহানুভব হয়ে কল করেছেন।
কিন্তু যা বললেন তা শুনে উল্টো আমার মন আরও খারাপ হয়ে যায়। তার কথার সারমর্ম ছিল এই যে, এতদিন তিনি আমাকে মানবতাবাদী ভাবতেন। কিন্তু পশুসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল এর 'মালাউন' গালির প্রতিবাদ করে আমার কথা বলার ধরণ দেখে উনি আজকে বুঝতে পেরেছেন যে আমি নাকি আসলে একজন 'হিন্দুত্ববাদী'!
দেশ থেকে বাইরে এসে এত উন্নত সমাজ ব্যবস্থার অংশ হয়ে থেকেও অনেকের মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। দেশের মানুষের কথা আর কী বলবো। যে দেশে নিজেরা সংখ্যালঘু সে দেশে নিজের শতভাগ অধিকার চাই আর যেখানে নিজেরা সংখ্যাগুরু সেখানে 'সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নাই'- এই মতবাদে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যাটা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি হবার কারণেই সমাধানের পথে এগুনো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
যতদিন না সবাই এই মন মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে একসঙ্গে আওয়াজ না তুলবে ততদিন মুক্তি নেই। সরকারি শক্ত পদক্ষেপের পাশাপাশি একটা আমূল পরিবর্তন দরকার দেশ বিদেশের সব বাংলাদেশির মন মানসিকতায়।
ধর্ম-মতবিশ্বাস ভুলে যেদিন সবাই আগে 'মানুষ' হবে, আত্ম-পরিচয়ে 'আস্তিক/নাস্তিক', 'হিন্দু', 'মুসলিম', 'বৌদ্ধ', 'খৃস্টান' 'আদিবাসী' না হয়ে 'বাংলাদেশি' হবে সেদিনই শুধু সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হওয়া সম্ভব হবে। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সদস্য
ই-মেইল: [email protected]