যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হবার পক্ষে গণভোটের রায় আসার পরে খুব কাছের এক ছোট ভাই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলো। সেখানে লিখেছিল, ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে কারণ সে তৎকালীন হোম সেক্রেটারি টেরিজা মে'র ওপর বিরক্ত ছিল।
Published : 29 Oct 2016, 06:51 PM
সে একজন ছাত্র হিসেবে যুক্তরাজ্যে এসেছে। তার যুক্তি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ছাত্ররা, বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশি ছাত্ররা গত কয়েক বছরে হোম অফিসের একের পর এক নিয়ম পরিবর্তন ও কড়া নীতির কারণে খুব কষ্টের মুখে পড়েছে। তাই সে খুশি যে, ব্রেক্সিট হওয়ায় ডেভিড ক্যামেরুন পদত্যাগ করেছেন। সেই সাথে টেরিজা মে'ও আর হোম সেক্রেটারি থাকছেন না।
কিন্তু নিয়তির পরিহাস দেখেন ! সেই ছোট ভাইয়ের পোস্ট দেয়ার দু'দিন পরই টেরিজা মে ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
ব্যাপারটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার একটা কারণ আছে। আপনারা যেন একটু ধারণা করতে পারেন যে কীভাবে ব্রেক্সিট ভোটারদের অনেকেই ব্যাপারটার পরিণতি কী হতে পারে, তা ভালো করে না বুঝেই ইউনিয়ন থেকে বের হবার জন্য ভোট দিয়ে খাল কেটে কুমির এনেছেন। আর এখন পস্তাচ্ছেন।
এখন যদি আরেকটা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দেওয়া অধিকাংশ ভোটাররা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ভোট দেবেন বলে আমার মনে হয়।
দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জেতার জন্য ক্যামেরনের একটি রাজনৈতিক জুয়া খেলা আর বরিস জনসন, মাইকেল গোভ ও নাইজেল ফারাজের মতো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী নেতাদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার ফলাফল হচ্ছে এই ব্রেক্সিট।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে,তাদের কারোরই যে ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্য কীভাবে এগোবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই তা ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর তাদের পরিণতি দেখেন, ডেভিড ক্যামেরুন পদত্যাগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে মাইকেল গভ আর বরিস জনসনের মধ্যকার নির্লজ্জ লড়াইয়ের ফাঁক দিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন টেরিজা মে। অথচ তিনি ব্রেক্সিটের ব্যাপারে বরাবরই একটা সুবিধাবাদী অবস্থান ছিলেন।
যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে খুব স্পষ্টভাবে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে জানানোর পরেও যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আসলে বের হয়ে যাবে কি না এ ব্যাপারে এখনও অনেকে সন্দিহান।
যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচাইতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বেশ কিছু বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান লন্ডন থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে ইউরোপের অন্যত্র স্থানান্তর করার কথা ভাবছে।
সবচাইতে হুমকির মুখে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ইউরোপিয়ান সিঙ্গেল মার্কেট থেকে বের হয়ে যাবার পর ইউরোপের সবচাইতে বড় অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে লন্ডন তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, সে নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
ব্রেক্সিটের পরে স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ইউরোপিয়ান সিঙ্গেল মার্কেটে থাকতে চায় বলে জানিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় তাই এখনও দ্বিতীয় রেফারেন্ডামের দাবি বার বার উঠছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
২.
প্রবাসী বাংলাদেশিরা সবচাইতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন পাউন্ডের মূল্য কমায়। অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে তাদের পরিবার-পরিজনকে টাকা পাঠান। ব্রেক্সিটের আগে পাউন্ড প্রতি টাকার মূল্য ছিল ১১৫-১২০ টাকা। এখন তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩-৯৫ টাকায়। ইউরোর চাইতেও এখন পাউন্ডের দাম কম। প্রতি লাখে ২০-২৫ হাজার টাকা ক্ষতি হচ্ছে প্রবাসীদের।
এবারের কোরবানি ঈদে প্রবাসীদের আক্ষেপ ছিল চোখে পড়ার মতো। এর প্রভাব বাংলাদেশে প্রবাসী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও পড়েছে। অনেকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। পাউন্ডের মূল্য বাড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এ অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
গত পাঁচ মাসে একটা পরিকল্পনা শুধু আমরা জানতে পেরেছি। আগামী বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ নাগাদ আর্টিকেল ৫০-এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হবার অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু করবে। কীভাবে করবে, ইইউ-এর সাথে কী কী চুক্তি করার চিন্তা-ভাবনা করছে, ইউরোপিয়ান সিঙ্গেল মার্কেট থেকে একেবারেই বের হয়ে যাবে কি না, যুক্তরাজ্যে থাকা ইউরোপিয়ান অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ কী- এসব কোনো ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট ধারণা কারোর নেই।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবার পক্ষের ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট দিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইমিগ্রান্টদের যুক্তরাজ্য থেকে তাড়ানোর ইচ্ছে থেকে। বিশেষ করে বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের কারণে যুক্তরাজ্যে গৃহহীনদের সংখ্যা ও অপরাধ বেড়ে যাওয়া, হোটেল-রেঁস্তোরায় চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়ানদের চাইতে সাদা চামড়ার ইস্টার্ন ইউরোপিয়ানদের অলিখিত প্রাধান্য পাওয়াকে অনেকে ব্রেক্সিটের পক্ষের কারণ হিসেবে দেখছেন।
ভোটের আগে আমার এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিতে চান?
সেই সহকর্মীই কোরবানি ঈদের সময় দেশে টাকা পাঠাতে গিয়ে ব্রেক্সিটের জন্য ডেভিড ক্যামেরুনের প্রতি তার ক্ষোভের কথা বলছিলেন। বলেছিলেন, তাদেরকে ভুল বোঝানো হয়েছে। ব্রেক্সিট কার্যকর হলে পরে তাদেরকেও ভিসা নিয়ে ইউরোপ যেতে হবে । তাদের সন্তানেরা ইউরোপের যে কোনো জায়গায় চাইলেই চাকরির জন্য যেতে পারবে না। অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটেন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে - এই ব্যাপারগুলো এখন তাদের মাথায় ঢুকছে।
৩.
লালনের গান- সময় গেলে সাধন হয় না। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে আমার অবস্থান ছিল বলেই হয়তো এখনো মন থেকে মানতে পারছি না। কিন্তু এটাই সত্যি যে দ্বিতীয় রেফারেন্ডাম হবার কোনো সম্ভাবনাই আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এখন আমরা যতই চাই না কেনো আর যত দাবিই উঠুক না কেনো, ব্রেক্সিট ঠেকানো হয়তো আর সম্ভব হবে না।
ব্রিটেনের জন্য ভালো চুক্তিগুলো করে নিয়ে ব্রিটেন ইইউ থেকে বের হয়ে যাবে সেটা অন্যরা মানবে কেনো। ইউরোপিয়ান নেতারা ইতোমধ্যেই ব্রিটেনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রেক্সিটের কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাথে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ব্রিটেন অফিসিয়ালি ছাড়ার কথা বলার আগে পর্যন্ত তারা কোনো রকম কোনো চুক্তির ব্যাপারে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করবে না।
তার মানে হচ্ছে এখন যদি দ্বিতীয় রেফারেন্ডাম করে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকার সিদ্ধান্তও নেয়, তাহলে ব্রিটেন আর আগের মতো তার প্রাধান্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বজায় রাখতে পারবে না।
ব্রেক্সিটের সমর্থনকারীরা ব্রেক্সিটকে ব্রিটেনের স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখন তারা কি বলবেন জানি না। তবে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ যে পুরোপুরি এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে তা বোধ করি এখন তারা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সদস্য
ই-মেইল: [email protected]