পাহাড়িদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাকে নিয়ে ‘রাজনৈতিক উপলব্ধির’ অভাব আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেছেন, “আমরা যখন সংবিধান প্রণয়ন করি, তখন তিনি (এমএন লারমা) যে কথাগুলো বলেছিলেন- তা আমরা গ্রহণ করতে পারি নাই। রাজনৈতিক উপলব্ধির অভাবে আমরা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীও ওভাবে করতে পারিনি।”
এম এন লারমার চল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজিত এক স্মরণসভায় মেনন এ কথা বলেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, মানবেন্দ্র লারমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারাও এগিয়ে এসে কথা বলেছিলেন। এই যে রাজনীতির উপলব্ধির অভাব; কেবল সেই সময় নয়, আজ অবধি চলছে।
“যদিও মাঝখানে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আমরা পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়েছিলাম। কিন্তু তার যে রাজনৈতিক তাৎপর্য, তার যে উপলব্ধি সেই জায়গাটায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি।”
মেনন বলেন, “সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চেষ্টা করলাম, তখনও ওই একইভাবে বাহাত্তরের মত পার্বত্যবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। বরং নতুন করে যে অভিধা দিয়েছি, সেগুলো গ্রহণযোগ্য তো নয়, হাস্যকরও বটে।
“আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অভিহিত করার মধ্য দিয়ে তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের যে অভিবাসন ঘটেছে, তার ফলে সেখানকার জনমিতির পরিবর্তন ঘটে গেছে প্রায় সমান সমান পর্যায়ে। আজকে আবার নতুন করে ষড়যন্ত্র বিদ্যমান, সেটা হল শান্তি চুক্তির সময়কালে পার্বত্যবাসীর প্রতি যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐকমত্যকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি যে এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে মেনন বলেন, “আমি আশা করব, নতুন প্রজন্ম মানবেন্দ্র লারমার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে, তার জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে তার লড়াইকে নতুন বাস্তবতায় নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসবেন। আমাদের এই বাংলাদেশ জাতিগত বৈচিত্র্যময় হোক, সেটাই আমার প্রত্যাশা।”
ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ সবুর বলেন, একটি জাতি তার ভাষার ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি যদি না পায়, তাহলে সেখান থেকে একটি দ্রোহ, দ্রোহ থেকে বিদ্রোহ এবং পরবর্তীতে সেটি সশস্ত্র লড়াইয়ে পরিণত হয়।
“আমরা সংবিধানে দেখেছি আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই প্রথম কাজ হচ্ছে সংবিধানে আদিবাসীর যে স্বীকৃতি তা দিতে হবে। এছাড়া শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমির অধিকার দিতে হবে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি আহ্বায়ক সুলতানা কামাল।
এ মানবাধিকারকর্মী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলাম, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, এত কষ্ট- তারপরও আমরা আমাদের হৃদয়টাকে প্রসারিত করতে পারলাম না সব মানুষকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। এটি আমাদের জন্য কত লজ্জার!
“আজকে মানবেন্দ্র লারমার যতগুলো দাবির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তার সবগুলোই এখনো জীবন্ত। এখনো সেই দাবি জানিয়ে আমাদেরকে লড়াই করতে হচ্ছে, আমি সকল দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি।”
সুলতানা কামাল বলেন, “ব্যক্তি স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে, একটি চেয়ারের দিকে নজর রেখে রাজনৈতিক স্বার্থে সমস্ত কিছু আমরা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবনের উপর বায়োপিক তৈরি করা উচিত, এটি একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আমাদের ইতিহাসে মানবেন্দ্র লারমা লিপিবদ্ধ থাকা উচিত, নয়তো এগুলো হারিয়ে যাবে।
“মানবেন্দ্র নারায়ণের অধিকার বঞ্চিতদের মানুষের কথা, মুক্তিকামী মানুষের কথা বলতেন। এগুলো কিন্তু ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়, যদি হারিয়ে যেতে দিই তাহলে আমরা ঐতিহাসিকভাবে দায়ী থাকব।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে সেখানে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অস্থায়ী প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠন। পরে আলোচনা সভা, কবিতা, প্রতিবাদী গান ও প্রদীপ প্রজ্বালনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবনী পাঠ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। স্বাগত বক্তব্য দেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজিন তিতিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সহ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, লেখক ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান।