নুর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘গোপন আঁতাতে’, অভিযোগ রেজার

রেজার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নুররা; তারা বলছেন, এসব ‘মনগড়া’ কথা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2023, 02:51 PM
Updated : 2 July 2023, 02:51 PM

গণঅধিকার পরিষদে কোন্দলের মধ্যে এবার নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপনে আঁতাতের অভিযোগ তুলেছেন রেজা কিবরিয়া।

তিনি রোববার সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, অর্থ নিয়ে আগামী নির্বাচনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন নুর, ক্ষমতাসীন জোটের কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।

পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে নুর সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে আগামী ১০ জুলাই দলের জাতীয় সম্মেলনেরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

দুই বছর আগে গণঅধিকার পরিষদের আত্মপ্রকাশের সময় রেজা কিবরিয়া আহ্বায়ক এবং নুর সদস্য সচিবের দায়িত্ব নেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

গত মাসের মাঝামাঝিতে রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়কের পদ থেকে সরানোর ঘোষণা দেন নুর। এর পাল্টায় নুরকেও সদস্য সচিবের পদ থেকে সরানোর ঘোষণা দেন রেজা।

এরপর দুই পক্ষের পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলার মধ্যে রোববার ঢাকার গুলশানে নিজের সংবাদ সম্মেলনে আসেন রেজা।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে নুরের ‘গোপন যোগাযোগের’ অভিযোগ তুলে রেজা বলেন, “আওয়ামী লীগের দুর্নীতি নিয়ে যখন জোর গলায় কিছু বলে … আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের আপত্তি করা উচিৎ। খেয়াল করবেন, তারা চুপ আছে। অর্থাৎ সে তাদেরই লোক।

“সে জাহাঙ্গীর কবির নানক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দেখা করেছে। সে মনে হয় ওদের মতো হতে চায়। মন্ত্রী হবে, কিছু টাকা-পয়সা বানাবে। এটাতে সে সন্তুষ্ট।”

সংবাদ সম্মেলনে রেজার পাশে ছিলেন গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা আহমেদ আফসারী। তাকে সাক্ষী রেখে রেজা বলেন, “আফসারীকে সে (নুর) বলেছেন, এই নির্বাচনে গেলে কেমন হয়? সরকার দুই কোটি টাকা দেবে নির্বাচনের জন্যে। ওকে (আফসারী) এক কোটি টাকা দেবে।

“আপনারা এটা কনফার্ম করতে পারেন আফসারী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেই। উনি আমার পাশেই আছে। সরকার তাকে এই অফারটা দিয়েছে।”

এ সময়ে আফসারীও মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেন।

নানা দাবিতে নুরের সমাবেশ ও সভা করার আসল উদ্দেশ্য অর্থ কামাই- এমন অভিযোগও আনেন রেজা কিবরিয়া।

তিনি বলেন, “অনেক সময় মিটিং করা হত টাকা তোলার জন্য। এই মিটিং কেন করছ- জিজ্ঞাসা করলে কোনো কারণ নাই, এটা কোনো উত্তর নাই। এই অজুহাতে প্রবাসীদের থেকে ৭/১০ লাখ টাকা তুলে ফেলত এবং খরচ করত।”

রেজা বলেন, “সরকার পতন ওই মিটিংয়ের কারণে হবে, এ রকম ধারণা আপনারাও করেননি, আমরাও করিনি, সরকারও করেনি। এগুলো হলো টাকা তোলার কৌশল।

“এই সব টাকার হিসাব দিত না। প্রবাসীরা চাকরি করে হালাল পয়সা রোজগার করে তাদের টাকা নিয়ে তোমরা খামাখা নষ্ট করছ। এটার কোনো মানে হতে পারে না। কিন্তু সে করেছে এবং করে যাচ্ছেই সে।”

মোসাদ প্রসঙ্গ

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কথিত এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুর বৈঠক করেছেন বলে আবারও অভিযোগ করেন রেজা।

তিনি বলেন, ‘‘এখন সবাই জানে যে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুরুল হক নুরের দুবাইয়ে মিটিং হয়েছে।

“দুবাই ও শারজাহ এর মাঝখানে একটি কফি শপে তাদের বৈঠক হয়েছে। এছাড়া দুবাইতে যে গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে গেছে, সেই চালক আমাকে এই বিষয়ে বলেছে। গত জুনের ১৮ তারিখে আমার বাসায় মিটিংয়ে আমাদের সামনে এই কথা স্বীকার করেছে নুর।”

এক প্রশ্নে রেজা বলেন, ‘‘অফকোর্স সে (নুর) বিশ্বাসঘাতক। ইসরায়েলিদের সঙ্গে মিট করাটাকে আমি অন্য কিছু বলতে পারি না। বিশ্বাসঘাতকতা শুধু আমার সঙ্গে না, সারাদেশের সঙ্গে, যুব সমাজের সঙ্গে এবং জাতির সঙ্গে। সে একটা প্রতারক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ।”

আমি জিয়ার ভক্ত: রেজা

আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা বলছেন, তিনি নিজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘ভক্ত’।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রশংসা করে রেজা বলেন, “সারা দেশে ও বিদেশে উনার মতো নেতৃত্ব দেওয়ার এবং মানুষকে সাহস দেওয়ার মানুষ খুব কম আছে।

“উনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব সম্মান করি এবং শহীদ জেনারেল জিয়াউর রহমানকেও খুব সম্মান করি। আমি জেনারেল জিয়ার ফ্যান…এটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তাই এই দলটার ক্ষতি করার বা ভাঙা প্রশ্নই উঠে না।”

বিএনপি ভাঙতে তার এই তৎপরতা- নুরের এমন অভিযোগ ‘অবান্তর’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি একটা ঠুনকো দল না যে, আমার কথায় ভেঙে যাবে। … তাহলে তো আমার অনেক ক্ষমতা!

“আমি মনে করি বিএনপি ভাঙলে একটা দল উপকৃত হবে, সেই দলটা হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো সুবিধা করে দিতে চাই না।”

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির উদ্যোগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল, তাতে গণফোরামের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন রেজা।

এরপর গণফোরামে কোন্দলে সেই দল ছেড়ে ২০২১ সালে নুরদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গণঅধিকার পরিষদে সম্পৃক্ত হন। গণঅধিকার পরিষদ দলটি গড়ে ওঠে চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় গঠিত ছাত্র অধিকার পরিষদের ধারাবাহিকতায়। এক সময় ছাত্রলীগে যুক্ত নুর ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা হয়ে ডাকসু নির্বাচন করে ভিপিও হয়েছিলেন।

গণঅধিকার পরিষদ গঠনের পর রেহা-নুররা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলছিল। আওয়ামী লীগবিরোধী প্ল্যাটফর্ম গণতন্ত্র মঞ্চেও যোগ দিয়েছিল তারা। তবে সম্প্রতি সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে তারা বেরিয়ে আসে।

সংবাদ সম্মেলনে রেজা কিবরিয়া দাবি করেন, তাতে আহ্বায়কের পদ থেকে সরাতে নুরদের পদক্ষেপ দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী।

তিনি বলেন, “আমাকে সরানোর জন্য সে (নুর) এত অস্থির হয়ে গেল যে ভোট ছাড়া সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিল। আমাদের যে সংবিধান আছে সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রীয় কমিটির ভোটে এই কাজটা করা সম্ভব। আহ্বায়ক বা সভাপতি সরানো ৮১ জনের ভোটে হয়। এটা হয়নি। আমাকে সরানোর জন্য যে ভোটটা হয়েছে, তাতে ৪৮ জনের মধ্যে ৩৬ জন সই করেছে। বাকিরা সইও করেনি।”

সেই বৈঠকের আগে কয়েকজনের নামে ভুয়া স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন রেজা কিবরিয়া।

‘ভুয়া স্বাক্ষর ও অনিয়মের ভোট’ করায় নুর ছাড়াও রাশেদ খাঁন (ঘোষিত ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক) ও শাকিল উজ জামানের বিরুদ্ধে মামলা করবেন তিনি।

এক প্রশ্নে রেজা বলেন, ‘‘দলের নেতৃত্ব আমার কাছেই আছে, থাকবে ইনশাল্লাহ। একটা লোকের (নুর) জন্য আজকে দলের এই অবস্থা। আমি মনে করি এটা ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের দলে অনেক ভালোভালো লোক আছে এবং তারা দলটাকে বাঁচাতে পারবে।”

সংবাদ সম্মেলনে গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন আহমেদ আফসারী, আবদুল মালেক ফরাজী, সহকারী সদস্য সচিব শেখ খায়রুল কবির, কেন্দ্রীয় নেতা জিসান মহসিন ও শাহাবুদ্দিন শুভও উপস্থিত ছিলেন।

রাতে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন জানিয়ে রেজা বলেন, তিন সপ্তাহ পরে দেশে ফিরে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করতে ‘বড় মিটিং’ ডাকবেন।

অভিযোগ অস্বীকার নুরের, সম্মেলনের ঘোষণা

রেজা কিবরিয়া বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনের সময় নুররা ছিলেন গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ে। রেজার অভিযোগের জবাব দিতে সেখানে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন নুর।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টের সঙ্গে কথিত বৈঠক নিয়ে রেজা কিবরিয়ার অভিযোগকে ‘মনগড়া’ বলে নাকচ করেন তিনি।

নুর বলেন, ‘‘ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কোনো সদস্যের সঙ্গে আমার কোনো বৈঠক হয়নি, কোনো অর্থ পাইনি। এসব উনার (রেজা কিবরিয়া) মনগড়া কথা।”

নুর সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবাব দেবেন না জানানোর পর দলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, “উনি (রেজা কিবরিয়া) যে অভিযোগ করেছেন যে, আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর কবির নানক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে আমাদের সদস্য সচিবের বৈঠক হয়েছে। এই রকম কোনো মিটিং হয়নি।”

রেজা কিবরিয়াকে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা হয়েছে দাবি করে নুর আগামী ১০ জুলাই দলের জাতীয় সম্মেলনেরও ঘোষণা দেন সংবাদ সম্মেলনে।

তিনি বলেন, “সেই কাউন্সিলে গণঅধিকার পরিষদের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।”

অন্য এক প্রশ্নে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব দাবি করেন, গঠনতন্ত্র মেনে পর্যপ্ত সংখ্যক নেতার মতামত নিয়ে রেজা কিবরিয়াকে নেতৃত্ব থেকে সরানো হয়েছে।

শুধু পাঁচ জন্য সদস্য এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং দুই জন সদস্য ভোটদানে বিরত ছিলেন বলে জানান তিনি।