রাজনৈতিক দলগুলোর জমা-খরচের হিসাব প্রকাশ না হলে তা নেওয়াটাই অর্থহীন বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
Published : 19 Aug 2023, 09:58 AM
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো এক যুগ ধরে নিজেদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী জমা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনে। অথচ তা প্রকাশ না হওয়ায় জনগণের জানার সুযোগ ঘটছে না।
দলগুলো ইসিতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে শুধু আয়, ব্যয় ও স্থিতির সংখ্যাটুকু জানিয়ে দেয় সংবাদ মাধ্যমে। দলীয় ওয়েবসাইট কিংবা ইসির ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয় না।
দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইন মেনে তারা জমা দিচ্ছে, প্রকাশ করা বা না করার এখতিয়ার ইসির। অন্যদিকে ইসির ভাষ্য, তারা এই হিসাব প্রকাশের জন্য নিচ্ছে না।
দলগুলোর জমা-খরচের এই হিসাব প্রকাশ না হলে তা নেওয়াটাই অর্থহীন বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রথা চালুর পর থেকে প্রতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আগের পঞ্জিকা বছরের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) আয়-ব্যয়ের হিসাব স্বীকৃত চার্টার্ড একাউন্টিং ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষা করে ইসিতে জমা দেয় রাজনৈতিক দলগুলো।
এবছর ২০২২ সালের অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল জুলাই মাস। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জেপিসহ নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে অর্ধেক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানান ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
তিনি বলেন, অন্তত ২০টি দল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে, বাকিরা সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে। কোনোটি এক মাস, দেড়-দুই মাস সময়ও চেয়েছে।
দলগুলোর আবেদন বিবেচনা করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়ার পক্ষে কমিশনে ফাইল উপস্থাপন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেদন দিতে সময় বাড়বে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব।
টানা তিন বছর অডিট রিপোর্ট জমা না দিলে নিবন্ধন বাতিলের এখতিয়ার রয়েছে ইসি। ২০২১ সালের প্রতিবছর সব দলই দিয়েছে। তাই চলতি বছর এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এখন কোনো দল নেই।
২০২২ সালে প্রধান তিন দলের আয়-ব্যয়
আওয়ামী লীগ: ২০২২ পঞ্জিকা বছরে ক্ষমতাসীন দলটি ১০ কোটি ৭১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৮ টাকা আয় দেখিয়েছে। ব্যয় দেখিয়েছে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৯ টাকা। তাতে উদ্বৃত্ত থেকেছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৫১ হাজার ১৮৯ টাকা। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান ইসিতে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়ে জানান, দলের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ৭৩ কোটি ২৮ লাখ ২১ হাজার ৩৫৫ টাকা।
বিএনপি: দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আয়-ব্যয় বিবরণী জমা দিয়ে জানান, ২০২২ সালে তার দলের আয় হয়েছে ৫ কোটি ৯২ লাখ ৪ হাজার ৬৩২ টাকা। মোট ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮০৩ টাকা। উদ্বৃত্ত ২ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮২৯ টাকা।
জাতীয় পাটি: দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২২ সালে তাদের আয় হয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার ৯৬৮ টাকা। ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪২ টাকা। ব্যাংকে স্থিতি আছে ১ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪২৬ টাকা।
এ টি এম শামসূল হুদা কমিশনের সময় দলগুলো অডিট রিপোর্ট জমা দিলেও কোনো পক্ষ থেকেই আর্থিক লেনদেনের সারসংক্ষেপের অঙ্কটাই জানাত না।
পরবর্তীকালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির আমলে প্রধান দলগুলো আয়, ব্যয় ও উদ্বৃত্তের অঙ্ক জানানো শুরু করে। তবে প্রতিবেদন জমা নিলেও ইসি কিছুই জানায় না।
আবার দলগুলো থেকে আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন নিলেও তা যাচাই করে দেখছে না ইসি। এক্ষেত্রে জনবল না থাকারকে কারণ দেখাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
অনীহা কেন?
২০১০ সালে আগের বছরের নিবন্ধিত দলের (২০০৯ পঞ্জিকা বছরের) অডিট রিপোর্ট পাওয়ার তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। দলগুলো নির্বাচনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করছে-এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”
সে সময় টাকার পরিমাণ জানাতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন উপ-দপ্তর সম্পাদক বলেছিলেন, “ইসি এ হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করবে। এ অবস্থায় ইসির সম্মতি ছাড়া আয়-ব্যয়ের পরিমাণ জানাতে পারছি না।”
২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন দলের উপ-দপ্তর সম্পাদক অডিট রিপোর্ট জমা দিয়ে হিসাব প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন খাত উল্লেখ করেছিলেন। তখনও তিনি বলেছিলেন, “প্রথাগত কারণে আমাদের পক্ষে তা প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। এটা এখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের সম্পদ। নির্বাচন কমিশন যদি প্রকাশ করতে চায়, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
জাতীয় পার্টি-জেপি’র সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনের প্রপার্টি। দলগুলো অডিট করেই প্রতিবেদন দেয়। নির্বাচন কমিশনও এটা প্রকাশ করতে পারে না।”
নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা (আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন) আমাদের কাছে জমা দেয় আইনগতভাবে। এই অডিট রিপোর্ট আমাদের কাছে একটা হেফাজত। সুতরাং এটা আমরা সবার কাছে প্রকাশ করতে পারি না।”
২০১৬ সালে আদালত ছয় নাগরিকের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিয়েছিল, রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশে বাধা নেই।
হাই কোর্টের সেই রায়ে বলা হয়েছিল, কোনো নাগরিক কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সেই দলের সম্মতি ছাড়াই তা প্রকাশ করতে পারবে।
উদ্যোগ অর্থহীন?
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম জানান, রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই হিসাব নেওয়া হচ্ছে, তা যদি জনগণ জানতেই না পারে, তাহলে মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা একটা অর্থহীন প্রক্রিয়া বা উদ্যোগ বলেই আমার মনে হচ্ছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার জন্যে দল ও ইসির উচিৎ জনগণের জ্ঞাতার্থে তা প্রকাশ করা।
“যে লক্ষ্যে অডিট রিপোর্ট নেওয়ার প্রথা চালু হল, তা যদি উন্মুক্ত করা না হয়, তাহলেও জনগণ বঞ্চিত হল। কোন খাতে কত আয় হল, কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তা বিস্তারিত জানানো উচিৎ।”
ইসির অনীহা নিয়ে আলীম বলেন, আইনে ইসিকে প্রকাশ না করতেও তো বলা হয়নি।
হিসাব প্রকাশে দলগুলোর অনীহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও ধরনের বিস্তারিত ব্যয় বিবরণী প্রকাশের সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। আবার প্রকাশ করলেও কিছু ঝুঁকি থাকে। কে কে দলকে অনুদান দিল, যিনি অনুদান দিয়েছে, তার নাম প্রকাশ হলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে কিংবা অন্যদের আক্রোশেরও শিকার তৈরি হতে পারে।