সংসদে উত্তাপ, প্রসঙ্গ এরশাদ

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের হৈ চৈয়ে বেগতিক অবস্থা দেখে অধিবেশনে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন স্পিকার।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2023, 06:00 PM
Updated : 30 Jan 2023, 06:00 PM

আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে বিএনপি চলে যাওয়ার পর নিস্তরঙ্গ সংসদে আকস্মিক উত্তাপ ছড়াল প্রয়াত এইচ এম এরশাদকে নিয়ে এক বক্তব্যে।

সোমবার সরকারি দলের সংসদ সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের এক বক্তব্যে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা তীব্র প্রতিবাদ জানান।

হৈ চৈয়ের সময় অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার সামসুল হক টুকু পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা করেন। বেগতিক পরিস্থিতিতে অধিবেশনে এসে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।

এসময় উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে তা পর্যবেক্ষণ করে এক্সপাঞ্জ করার রুলিং দেন স্পিকার।

এদিন সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা করছিলেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য মোতাহার।

তিনি বলেন, “ছয়বার সংসদে এবং দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। প্রথমবার ৫৫ হাজার ভোটে জিতেছি। গতবার জিতেছি ২ লাখ ৫৫ হাজার ভোটে। গত ভোটে (২০১৪) আমার স্ট্রং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মাত্র ৭ হাজার ভোট পেয়ে উনার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল হাতিবান্ধা-পাটগ্রামে।

“আরও একবার আমি সংসদ সদস্য হতে পারতাম। আগের দিন আমি জিতেছি ২৭শ’ ভোটে, পরেরদিন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাকে ২২শ’ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। তার ফলশ্রুতিতে গতবার আমার এলাকার ভোটার উনাকে (এরশাদ) জানিয়ে দিয়েছেন তার অবস্থাটা কী?”

মোতাহারের বক্তব্যের শুরুতে জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে ছিলেন না। তার বক্তব্য শুরুর কিছুক্ষণ পর অধিবেশনে এসে দলটির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় মোতাহার থেমে যান।

কিছুক্ষণ পর সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা ফিরোজ রশীদকে বসতে বলেন। তবে তিনি মাইক ছাড়াই কথা বলতে থাকেন।

এ সময় মোতাহার বলেন, “আমার সময়ে আরেকজন বক্তৃতা দেবেন কীভাবে?”

আবার মোতাহারকে দাঁড় করিয়ে রেখে কাজী ফিরোজ রশীদকে এক মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

তখন ডেপুটি স্পিকার বলেন, “আপনি পরে সময় নিয়ে যদি কোনো বক্তব্য থাকে বলবেন।”

এ সময় বিরোধী দলের প্রধান হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ দাড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। ডেপুটি স্পিকার তাকে সুযোগ দিলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা হৈ চৈ শুরু করেন।

রাঙ্গাঁ বলেন, “চলে যাব। চিৎকারের দরকার নেই, আমরা চলে যাব।”

ডেপুটি স্পিকারের কথায় কর্ণপাত না করে জাতীয় পার্টি এমপিরাও চিৎকার করতে থাকেন।

এ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার বলেন, “আপত্তিকর কিছু থাকলে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে। আর পয়েন্ট অব অর্ডারে অন্য সুযোগে আপনি কথা বলবেন। আপনারা বসেন আমি পয়েন্ট অব অর্ডারে সুযোগ দেব।”

ঠিক এই সময়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তড়িঘড়ি করে অধিবেশন কক্ষে ঢুকে সভাপতির আসন নেন। তিনি চেয়ারে বসেই সবাইকে বসতে বলেন।

বিরোধী দলের দুই সংসদ সদস্যের উদ্দেশে তিনি বলেন, “হাউসের একটি ডেকোরাম আছে। এখানে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনা হচ্ছে। এখানে একজন বক্তা তার বক্তব্য রাখছেন। সেই বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা আপনারা উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এজন্য আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। উনি (মোতাহার) উনার বক্তব্য শেষ করবেন।

“আপনারা হাত তুলবেন। আমরা যখন মনে করব, আপনাদেরকে সুযোগ দেওয়ার বিষয় আছে, আমরা সেই সুযোগ দেবো। আপনাদের কথাও শোনা হবে। যদি এমন কোনো বিষয় থাকে, যেটা এক্সপাঞ্জ করার প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ আছে। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনা চলমান থাকার সময়ে একজন বক্তা যখন বক্তব্য দিচ্ছেন …. সেই বক্তব্য চলাকালীন আপনি হাত তুলে আপত্তি করেছেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তারপরে সেই মুহূর্তে পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা করা সমীচীন নয়। এজেন্ডার মাঝখানে নয়। কাজেই আমি আপনাদের কাছ থেকে সেই সহযোগিতা আশা করছি।”

পরে মোতাহার হোসেনকে তার বক্তব্য শেষ করতে দেন স্পিকার। তিনি বক্তব্য শেষ করার পর রাঙ্গাঁকে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেন স্পিকার।

জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রাঙ্গাঁ ২০১৪ সালে এরশাদের মনোনয়নপত্র জমার বিষয় তুলে ধরে বলেন, “যে কোনোভাবেই হোক, উনি ২০১৪ সালে নির্বাচন করতে চাননি।

“হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পরাজিত করে উনি সংসদে এসেছেন, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আপনি (স্পিকার) এটা এক্সপাঞ্জ করে দেবেন।”

পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফিরোজ রশীদ বলেন, “মোতাহার সাহেবের ভালো করে জানা উচিৎ, এরশাদ সাহেব রংপুরের মাটিতে কোনোদিন হারেননি। এরশাদ সাহেবের জামানত রংপুরে বাজেয়াপ্ত করার মতো সন্তান রংপুরে আজ পর্যন্ত জন্ম নেয়নি। এটা সম্পূর্ণ এক্সপাঞ্জ চাই। না হলে রংপুরের মাটিতে তার অসুবিধা হবে।”

পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রুলিংয়ে বলেন, “মোতাহার হোসেনের বক্তব্যে যদি কোনো তথ্যগত ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে সেটা বিবেচনা করে তা পরীক্ষা করে এক্সপাঞ্জ করারর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

নাটকীয় এক পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান এরশাদ লালমনিরহাট-১, ঢাকা-১৭ ও রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। পরে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি, সব কটি আসনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদনও করেন। তবে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়নি।

ইসির ঘোষিত ফলে লালমনিরহাটে ৫ হাজারে ৩৮১ ভোট পান এরশাদ। আওয়ামী লীগের মোতাহার পান ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮১৪ ভোট। ঢাকা-১৭ আসনেও স্বল্প সংখ্যক ভোট পান তিনি। তবে প্রচার না চালিয়েও রংপুর-৩ আসনে তিনি নির্বাচিত হন। পরে হাসপাতালে ছেড়ে তিনি এমপি হিসেবে শপথও নেন।