‘মুক্তির মহামন্ত্র’ এসেছিল যেদিন

নানা কর্মসূচিতে পালিত হবে ৭ মার্চ, একাত্তরের যে দিনটিতে ঐতিহাসিক সেই ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2023, 05:13 PM
Updated : 6 March 2023, 05:13 PM

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে বাংলার মানুষে পেয়েছিল মুক্তির মন্ত্র।

“সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের”- কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার এই পঙক্তিতে বাঙময় হয়ে আছে বাঙালির মুক্তির মন্ত্র পাওয়ার সেই দিনের ঐতিহাসিকতা।

সুদীর্ঘ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের দিনটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তা আজ সারাবিশ্বেই সমাদৃত।

তৎকালীন রেস কোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি আরও বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।”

এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি শোষক, দখলদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আসে স্বাধীনতা।

সাতই মার্চের ভাষণের সেই গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এ ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজের’ মর্যাদা দিয়েছে।

মঙ্গলবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পালন হবে ঐতিহাসিক সেই দিন।

দিনটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, অবিস্মরণীয় সেই ভাষণ ছিল ‘জাতির মুক্তির মহামন্ত্র’।

“পুরো বাঙালি জাতি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবগাহন করেছিল রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতা। মাত্র ১৮ মিনিটের এই মহাকাব্যে ধ্বনিত হয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মহামন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর শাণিত ও প্রদীপ্ত উচ্চারণে কেঁপে উঠেছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের মসনদ। মূলত ৭ই মার্চের ভাষণেই নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল শোষণমুক্তির কাঙ্ক্ষিত পথ। তাই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির মুক্তির মহাকাব্য।”

দিবসের বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। একমাত্র তিনিই ছিলেন হাজার বছরের শোষিত-বঞ্চিত বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

“রাজনীতির কালজয়ী কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ভাষণের মাধ্যমে দেশের শাসনভার জনগণের হাতেই তুলে দেন, ক্ষমতাকে কী করে নিয়ন্ত্রিতভাবে সকলের কল্যাণে ব্যবহার করতে হয় তাও বুঝিয়ে দেন, শিখিয়ে দেন আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধক সমরনীতি, যুদ্ধকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি। সেই মর্মস্পর্শী বজ্রনিনাদ ৭ কোটি বাঙালির হৃদয়কে বিদ্যুৎ গতিতে আবিষ্ট করেছিল।”

বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সেই ভাষণের অনুপ্রেরণায় উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য বিধি মেনে জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে সকাল ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে আওয়ামী লীগ।

সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

বিকাল সাড়ে ৩টায় ফার্মগেইটের কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যম বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে গৃহীত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে সহযোগী সংগঠনগুলোর সব স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সেদিন রেসকোর্সে

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা।

বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনসমুদ্রের উদ্দেশে।

তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

তিনি বলেন- “... আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “...সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।”

উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত আদেশ- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।

রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের সব বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সম্প্রচার কার্যক্রম।

ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।