নৌকা নিয়ে লড়বেন আওয়ামী লীগের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তার এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। এদের দুজনই সংসদ সদস্য।
Published : 07 Dec 2023, 10:16 PM
কুমিল্লা আওয়ামী লীগে বছরের পর বছর ধরে দুটি পক্ষের মধ্যে যে বিভেদ, তার প্রভাব পড়েছে এবারের সংসদ নির্বাচনেও।
আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনে টানা তিন বারের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারকে আবার প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। দলে তার এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা নৌকা না পেয়ে হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
সীমাও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।
গত ৪ নভেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্রই বৈধ ঘোষণা হয়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত সীমা প্রার্থী থাকেন, তাহলে একই আসনে দুইজন সংসদ সদস্যের লড়াই দেখতে যাচ্ছে কুমিল্লার ভোটাররা।
দলের মনোনয়ন না পেয়ে অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ইতিহাস আছে বাহারেরও। আওয়ামী লীগের এই ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়েছে বিএনপি।
একই আসনে দুই সংসদ সদস্যের লড়াইয়ের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মাদারীপুর-৩ আসনেও। সেখানে বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য তাহমিনা বেগম সিদ্দিকী। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিনই নিশ্চিত হবে এই লড়াই শেষমেশ হবে কি না।
সংসদ সদস্যরা পদে থেকে নির্বাচন করতে পারছেন দশম সংসদ নির্বাচন থেকে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে। সংবিধানে এখন সংসদের মেয়াদের শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা আছে। এই সময়ে সংসদ বসবে না, কিন্তু তা ভেঙেও দেওয়া হবে না।
এর আগ পর্যন্ত সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হতো, ফলে সংসদ সদস্যদের পদে থেকে ভোটের সুযোগ ছিল না।
কুমিল্লায় বাহার ও সীমার এই বিরোধ কিন্তু অতীতের বিরোধের ধারাবাহিকতা।
সীমার বাবা আফজল খানের সঙ্গেই মূলত বাহারের বিরোধের শুরু। এই বিরোধে নানা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সেখানে হেরেছে বারবার।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনেও কুমিল্লা সদর আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও দলীয় প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট বিজয়ী বিএনপির প্রার্থী আকবর হোসেনের চেয়ে বেশি ছিল।
সেই নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে আকবর জেতেন ৬৫ হাজার ৪৪৭ ভোট পেয়ে। নৌকার প্রার্থী এটিএম শামসুল হক পান ৩৪ হাজার ৩৯৯ ভোট।
বাহার সেই নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পান ৩১ হাজার ৪৯০ ভোট। আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের ভোট বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে বেশি ছিল।
২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আফজল খানের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা প্রয়াত নেতার সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সন্তানদের মধ্যে আফজলের ছেলেও মারা গেছেন। এখন সবাই সীমার পাশে।
বাহার এখন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সীমা দলের মহানগর শাখার উপদেষ্টা। তিনি আগে এই কমিটির সহসভাপতিও ছিলেন।
নগরীতে আওয়ামী লীগের মূলধারার নিয়ন্ত্রয়ক মূলত বাহার। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রায় সব নেতাই তার অনুসারী। তবে বাহারবিরোধীরা আছেন সীমার পক্ষে।
আফজল-বাহারের বিরোধের শুরু যেভাবে
১৯৮৪ সালে আফজল ছিলেন কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাহার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।
সে বছর পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হন আফজল। বাহার তাকে সমর্থন না দিয়ে নিজেও ভোটে নামেন, জিতেও যান।
সেই নির্বাচনের পর থেকেই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এরপর একজন ভোটে দাঁড়ালে অন্যজন তার বিরোধিতা করেছেন, এটি এক নিয়মিত চিত্র ছিল সেখানে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে জিতে ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো আসনটি পায় আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনের বাহারকে মনোনয়ন দিয়ে আফজলকে নির্দেশ দেওয়া হয় একসঙ্গে কাজ করতে। তার ফলও মেলে। ২৪ হাজার ভোটে জয় পায় নৌকা।
তবে সেই ঐক্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে এসেই প্রকাশ্যে আসে পুরনো দ্বন্দ্ব আর বিরোধ।
সেই নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খান। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর কাছে হেরে যান ৩৫ হাজার ভোটে।
এরপর আফজল পরিবার তখন অভিযোগ তোলে, বাহারের বিরোধিতায় এই ফল হয়েছে নির্বাচনে। ভোটের ফলাফল পর্যালোচনাতেও দেখা যায় বাহারের প্রভাবিত এলাকায় বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন আফজল।
বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে বাহারের সঙ্গে আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।
তবে সুবিধা করতে পারেননি আফজলপুত্র। তিনি পান ৩৮ হাজার ২৯৩ ভোট। নৌকা নিয়ে বাহার পান ৫৯ হাজার ২৫ ভোট, জয় আসে ২১ হাজার ভোটে।
ভেতরের ছবি: কুমিল্লাতেই আছেন বাহার, আলোচনার কেন্দ্রে
২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হারলেও পরের তিনটি নির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয় পান আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তাকে এবারও মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ
২০১৭ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজল কন্যা সীমাকে। কুমিল্লায় দুই পক্ষ যেন এক হয়ে লড়াই করে, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি।
সীমা ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারেন ১১ হাজারে। হেরে যাওয়ার পর তার অনুসারীরা আবার বাহারের বিরুদ্ধে আনেন অসহযোগিতার অভিযোগ। এবারও দেখা যায়, বাহারের প্রভাবিত কেন্দ্রগুলোতে হেরে গেছে নৌকা।
গত বছর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দুই পরিবারের কাউকে না নিয়ে বেছে নেওয়া হয় আরফানুল হক রিফাতকে। তিনিও বাহারের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। নৌকা না পেয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন আফজলপুত্র মাসুদ পারভেজ ইমরান। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন।
সিটি করপোরেশনে দুই বার এবং এর আগে পৌরসভা থাকার সময় আরও দুটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর প্রথম রিফাতের হাত ধরে জয় পায় আওয়ামী লীগ।
আফজলপুত্র সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য তিনি লড়াই করবেন, এমন একটি প্রচার ছিল। তবে চলতি বছরের ৬ মার্চ তিনি মারা যান। ফলে বাবার ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের’ প্রশ্নে একা হয়ে যান সীমা।
বাহার-সীমা কে কী বলছেন
নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে সীমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রিয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছেন এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে বাধা নেই, দলীয়ভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত। কুমিল্লার মানুষ তাদের দীর্ঘদিনের কষ্টের অবসান চায়। তাই মানুষের আগ্রহে আমি প্রার্থী হয়েছি। আশা করি জয়ী হব।”
তবে আফজল বলয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবারও জয় পাওয়ার আশা করছেন বাহার। তিনি বলেন, “আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ১৯৮৪ সালে পারেনি, ২০১৪ সালেও পারেনি, ইনশাআল্লাহ এবারও পারবে না। আশা করছি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এবারও এই আসন বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে উপহার দেব।”
কুমিল্লা আওয়ামী লীগ স্পষ্টতই বিভক্ত। দলের দক্ষিণ জেলা কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সফিকুল ইসলাম শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লার মানুষ পরিবর্তন চায়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সীমাই নির্বাচিত হবেন।”
বাহার অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুর রহমান বলেন, “বাহারের সঙ্গে কুমিল্লার মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। তিনি ভোটের রাজনীতিতে ও সাংগঠনিকভাবে তিনি দক্ষ। খান পরিবারের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে তিনি সব সময় জিতেছেন, এবারও জিতবেন।”