গত ২৩ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর শাহীনুর দাবি করেছিলেন, তিনি মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। এখন বলছেন, সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন তিনি।
Published : 01 Dec 2023, 08:59 PM
নভেম্বরের শেষে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসা ধর্মভিত্তিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা শাহীনুর পাশা চৌধুরী জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোটে প্রার্থী হয়েছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে যে আসনে একাধিকবার লড়াই করেছেন, সেই সুনামগঞ্জ-৩ আসনে এবার তিনি লড়বেন নতুন নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ নিয়ে।
গত ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর বিষয়টিকে ‘ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ’ দাবি করা এই নেতা এখন স্বীকার করেছেন, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে গণভবনে গিয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনার বক্তব্যে নিশ্চিত হয়েছেন, ভোট ‘সুষ্ঠু হবে’। এ কারণে প্রার্থী হয়েছেন।
সেই সাক্ষাতের খবর গণমাধ্যমে আসার পর তার দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী ক্ষুব্ধ হয়, শাহীনুরের দলের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। আর শাহীনুর ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে সমর্থকদের কেউ আঘাত পেলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন।
তবে ঠিক এক সপ্তাহ পরে বৃহস্পতিবার শাহীনুর নিজে উপস্থিত হয়ে তার আসনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
আসনটিতে শাহীনুরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, যার কাছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে প্রায় ৭৮ হাজার এবং ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি ভোটে হেরেছিলেন।
এক সপ্তাহের নাটকীয়তা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য, নিজ দলে অপাংক্তেয় হওয়া, ধর্মভিত্তিক একটি দলের রাজনীতি করে ভোটে অংশ নিতে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন শাহীনুর পাশা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি যে দল করতেন, সেটি তো ভোট বর্জন করেছে। আপনি কেন অংশ নিলেন?
শাহীনুর পাশা: ২৫ বছর ধরে আমি যে দলে (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম) ছিলাম, সেই দল দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা নির্বাচনে যাবে না, আমি ভেবেছি যাওয়া উচিত।
কেন এটা ভেবেছেন?
কারণ এলাকার মানুষের কাছে আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমারও বয়স হয়ে গেছে, এটাই হয়ত আমার শেষ নির্বাচন। আমি মনে করেছি এখানে ভালো সুযোগ আছে। নির্বাচনে জয় লাভ করলে আমি তাদের খেদমত করতে পারব। তাই ভোটে এসেছি।
জগন্নাথপুরের মানুষ আমাকে চেনে, তারা আমাকে সমর্থন করে। আমি মনে করি আমার জয়ের একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।
আপনি এর আগে যেসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, প্রতিটিতেই লড়েছেন ধানের শীষ নিয়ে। ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী। তারা ভোট বর্জন করেছে। তাদের সমর্থন ছাড়া আপনি কীভাবে ভালো করবেন?
আমি বিশ্বাস করি, আমি মানুষের মন জয় করতে পেরেছি। কিছু অন্ধ ভক্ত অথবা যারা অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তারা হয়ত ভোট কেন্দ্রে যাবে না। বাকিরা কিন্তু কেন্দ্রে যাবে এবং আমাকে ভোট দেবে।
গত ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেন দেখা করেছিলেন?
আমি আসলে আমি নিশ্চয়তার জন্য গিয়েছিলাম যে নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে কি না।
আমার এলাকায় পরিকল্পনা মন্ত্রী মহোদয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় বলে আমি মনে করি। সেই হিসাবে আমার বেশ ভালো একটা সুযোগ আছে। তাই আমি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিশ্চয়তা চাইছিলাম যে ভোটে কেউ বাধা দেবে না।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কী মনে হল?
ওনার কথা, ওনার ভঙ্গি দেখে আশ্বস্ত হয়েছি যে ফেয়ার ইলেকশন হবে।
আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যেহেতু আশ্বাস পেয়েছি, আশ্বস্ত হয়েছি, হানড্রেড পারসেন্ট ফেয়ার ইলেকশন হবে। সেটি হলে এই আসনে শাহীনুর পাশা ছাড়া বিকল্প নেই।
আপনি তো স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারতেন, কেন তৃণমূল বিএনপির প্রতীক নিলেন?
এটা আমার দূরদর্শিতার অভাব স্বীকার করি। আমি জানতাম না সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে ভোটারের এক শতাংশ স্বাক্ষরের প্রয়োজন নেই।
আমার আসনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪৪ হাজার, সেই হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটারের সই লাগত। একটা সই যদি ভুল হয়ে যায়, তাহলেই মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। তাই একটা দল বেছে নিয়েছি।
আপনি সারা জীবন করলেন ইসলামী রাজনীতি, ধর্মভিত্তিক কোনো দল কেন বেছে নিলেন না বা জাতীয় পার্টি অথবা অন্য দলে গেলেন না?
ইসলামী বাকি দলের সঙ্গে আমার মিল নাই। আর জাতীয় পার্টির প্রতীকে আমি ভোট করতে চাইনি। সেই হিসাবে ভাবলাম তৃণমূল ভালো হবে, সেখান থেকে জিতলে বা হারলে কোনো লোকসান নেই।
‘প্রভাব বিস্তার করলে ভোট থেকে সরে দাঁড়াব’
বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশে শাহীনুর পাশা যে বক্তব্য রাখেন তাতে তিনি বলেন, “আমি আশ্বাস্ত হয়েছি, সরকার ফেয়ার ইলেকশন আমাদেরকে উপহার দেবে। আমরা সকলে যদি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারি, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারি, আমাদের বিজয় নিশ্চিত।”
দীর্ঘদিন ধরে যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তাদেরকে ফেলে ভোটে আসায় কারও ‘হীনমন্যতায় ভোগার কারণ নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেকে অন্য মাইন্ডে চিন্তা করেছেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, তিনি আমাকে হানড্রেড পারসেন্ট কনফিডেন্স নিয়ে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, কেউ কোনোভাবে কারচুপি করার অথবা প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে না।”
ধানের শীষের সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, “প্রশাসন থেকে কেউ যদি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ আছে।
“আমি আহ্বান করব প্রশাসনের ভাইয়েরা, আপনারা আমাদের সেবক হিসেবে কাজ করেন। কোনো পক্ষাবলম্বন যদি করেন, আমরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব।”
কে এই শাহীনুর পাশা চৌধুরী
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে জেতেন শাহীনুর পাশা।
১৯৯৯ সালে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী ঐক্যজোট যে মোর্চা গঠন করে, সেই ঐক্যজোটের একটি দল ছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী। সেই দলের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ নিয়ে ২০০১ সালে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। তবে হেরে যান আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদের কাছে।
সামাদ আজাদ ২০০৫ সালে মারা গেলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উপনির্বাচনে জিতে সংসদে আসেন শাহীনুর।
তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নানের কাছে তিনি হারেন বড় ব্যবধানে।
ধানের শীষ নিয়ে সেই নির্বাচনে শাহীনুর পান ৫৬ হাজার ৪৭১ভোট। নৌকার প্রার্থী মান্নানের বাক্সে পড়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬৬ টি।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেন শাহীনুর। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আবার ধানের শীষ নিয়ে লড়েন। এই নির্বাচনে ১০ বছরের আগের চেয়ে ভোট কমে যায় জমিয়ত নেতার। তিনি পান ৫২ হাজার ৯২৫ ভোট, মান্নান পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৪৯টি।
ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে জমিয়তের একটি অংশ এখনও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে।
শাহীনুর যে অংশের নেতা, সেই অংশটি ‘ইসলামী সমমনা দলসমূহ’ নামে একটি মোর্চার অংশ। এই মোর্চার মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ভোটে এলেও আসেনি জমিয়তের একাংশ।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর কী বলেছিলেন শাহীনুর
গত ২৩ নভেম্বর শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসার পর শাহীনুর অনুসারীদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া হয়।
সেই রাতেই তিনি তার ফেইসবুক পেজে লেখেন, “পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় প্রকাশ নয়টি ইসলামী দলের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। আমার সাক্ষাৎটি ছিল ব্যক্তিগত, দলীয় নয়।”
এর পরদিন দলীয় সদস্যপদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আসার পর তিনি আবার পোস্ট দেন ফেইসবুকে।
এবার তিনি লেখেন, “গতরাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইসলামী নয়টি দলের সাক্ষাতে জমিয়তের নামটিও মিডিয়ায় এসেছে। আর তাতে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং জমিয়তপ্রেমীরা মনে কষ্ট পেয়েছেন।
“আমার বক্তব্য কাল রাতেই পরিষ্কার করেছি। এটা আমার প্রিয় দল জমিয়তের প্রতিনিধিত্ব নয়, সাক্ষাৎটি আমার ব্যক্তিগত।”
শাহীনুর পাশা লেখেন, “যার সহযোগিতায় গণভবনে গিয়েছি, তিনিই আমাকে একদিন আগে বলেছেন, জমিয়ত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। সুতরাং ওখানে আমি জমিয়ত নেতা হিসেবে যাইনি। আমার মামলাগুলো উইথড্র করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে গিয়েছিলাম।”
“দেশের ‘সুপ্রিম অথরিটির কাছে’ যে কেউ সুযোগ পেলে তার আবদার পেশ করার জন্য যাওয়ার অধিকার রয়েছে” মন্তব্য করে তিনি লেখেন, “এরপরেও যারা কষ্ট পেয়েছেন, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।”
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অতীতে আরো চারবার সাক্ষাৎ হয়েছে জানিয়ে ধানের শীষের সাবেক এমপি বলেন, “ওই সাক্ষাৎকারগুলোর দলনেতা ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা মুহি উদ্দীন খান রহ. মাওলানা মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ, মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস রহ.।”
তিনি যে তিনজনের নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে মুফতি আমিনী ও মুফতি ওয়াক্কাস ২০০১ সাল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিপাকে ‘ধানের শীষের’ সাবেক এমপি