গাজীপুর নগরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের কথা অনেকে বললেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অন্তর্দ্বন্দ্বকেই প্রধান করে দেখছেন স্থানীয়রা।
Published : 08 Jul 2013, 05:14 AM
শনিবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে ১৮ দলীয় প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে এক লাখের বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন ১৪ দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খান। অথচ বিগত বছরগুলোতে ঢাকার লাগোয়া এই এলাকায় স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের একচেটিয়া জয়ের কারণে গাজীপুরকে বলা হচ্ছিল আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ঘাঁটি।
এ কারণে শনিবার রাতে ভোটের ফল ঘোষণা শুরুর পর থেকেই আজমতের পরাজয়ের কারণ নিয়ে শুরু হয় নানা ধরনের আলোচনা ও বিশ্লেষণ। আর তাতে স্থানীয়ভাবে দলীয় বিভক্তির কথা যেমন এসেছে, পাশাপাশি এসেছে সাংগঠনিক কার্যক্রম ও প্রচার কাজে ‘দুর্বলতার’ কথাও।
টঙ্গী ও গাজীপুরের সঙ্গে ছয়টি ইউনিয়ন যুক্ত করে ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় এই সিটি কর্পোরেশন গঠনের ঘোষণা আসে গত জানুয়ারিতে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত। আর গাজীপুর পৌরসভায় টানা নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক, যিনি এখন সংসদ সদস্য।
আজমত তার নিজের এলাকা টঙ্গীর ১৩৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০০টিতেই হেরেছেন। হেরেছেন গাছার ৪৬টির মধ্যে ৪১টি, পূবাইলে ২১টির ১০টি, বাসনে ৩৪টির ৩৩টি, কাশিমপুরে ৪০টির ৩৮টি, কোনাবাড়ীতে ৩৫টির সবকটিতে এবং গাজীপুর পৌরসভায় ৪৮টির মধ্যে ৪১টি কেন্দ্রে।
গাজীপুরের দুটি সংসদীয় এলাকার দুই সংসদ সদস্যও আওয়ামী লীগের। গাছা, টঙ্গী ও গাজীপুর সদর পৌরসভার আংশিক নিয়ে গঠিত একটি আসনের সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল সাবেক সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। আর অন্য আসনটি থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকম মোজাম্মেল হক।
দলের মতের বিরুদ্ধে মেয়র পদে ভোটে দাঁড়িয়ে এ নির্বাচনের শুরু থেকেই আলোচনায় ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গাজীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। পরে দলের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তিনি সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও ব্যালট পেপারে প্রার্থী হিসাবে জাহাঙ্গীরের নাম আর দলের ভেতরে সন্দেহ আর বিভাজন থেকেই যায়।
জাহাঙ্গীর শেষ পর্যন্ত আজমতের পক্ষে কতোটা কাজ করেছেন তা নিয়ে গাজীপুরের সব জায়গায় আলোচনা চলছে ভোটের পর থেকেই। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আঙুল তুলেছেন দুই নেতার বিরুদ্ধে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন হওয়ার আগে ১৫ বছর গাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এই আওয়ামী লীগ নেতার অভিযোগ, সাংসদ রাসেল ও জাহাঙ্গীর তাদের অনুসারীদের ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীর বাক্সে ভোট দেয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন।
“সব এলাকাতেই ওরা মান্নানকে ভোট দিয়েছে। তা না হলে আজমত উল্লা ভাই মান্নানের চেয়ে অন্তত এক লাখ ভোট বেশি পেত।” আজমতের পরাজয়ের জন্য দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই প্রধাণ কারণ মনে করছেন গাজীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা কমিটির সদস্য আইনজীবী ওয়াজ উদ্দিন মিয়া। তার দাবি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংগঠিত থাকলে আজমতকে হারতে হতো না।
“শুরুতেই প্রার্থী নিয়া কতো ক্যাচাল হইলো। সব শেষে যখন নির্বাচন করতে নামলাম, তখন আমাদের হাতে সময় মাত্র ৭-৮দিন। এর মধ্যে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে একবার বসতেও পারিনি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দলের ইউনিটগুলো নিয়ে একটা বর্ধিত সভাও করতে পারিনি। পাঁচ এমপিও একসঙ্গে বসেন নাই।”
স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমুল পর্যায়ে যারা আজমতের হয়ে কাজ করার কথা, তাদের অনেকেই কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় নিজেদের নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
তবে আজমতের নিজের এলাকা টঙ্গীতে হারের পেছনে পৌর মেয়রের দায়িত্বে তার দীর্ঘদিন থাকার বিষয়টিও কাজ করেছে বলে মনে করছেন দলের কেউ কেউ।
তাছাড়া জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দূরত্ব এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার অভিযোগ এসেছে কারো কারো কথায়।
ওয়াজ উদ্দিন মিয়া বলেন, “টঙ্গীতে যে বিষয়টি ঘটেছে, অনেকদিন পদে থাকলে কিছু মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক বিষয় তৈরি হয়। যাদের মধ্যে এটা তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষোভ মিটিয়ে তাদেরকে নির্বাচনে নামানো যায়নি। অন্যদিকে আজমত উল্লাহ সেখানে ‘মাই ম্যান’ সৃষ্টি করেছেন। এমপির লোকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন। এদেরকেও তিনি নির্বাচনে সেইভাবে নামাতে পারেননি।”
অবশ্য আজমতকে অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে সাংসদ রাসেল বলেন, “কোন জায়গার ভোট পাইছে বলেন? আমার এলাকার চেয়ে অন্য এমপিদের এলাকায়তো আরো কম ভোট পাইছে। একা কেন রাসেলের কথা বলা হচ্ছে।”
সুযোগ পেলে সবাই ‘ল্যাঙ মারতে চায়’- এমন মন্তব্য করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ বলতে পারবে না, এমপি সাহেব ভোট দিতে নিষেধ করছে বা অন্য প্রার্থীকে ভোট দিতে বলছে। এতো খাটলাম... তারপরও এই কথা!”
আর বিদ্রোহী হওয়ার যাকে নিয়ে দলে সন্দেহ, সেই জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, আজমত উল্লা হেরেছেন তার ‘জনবিচ্ছিন্নতা’ কারণে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যিনি প্রার্থী হয়েছেন তার সঙ্গে এলাকার মানুষের যোগাযোগ নাই। হঠাৎ করে ভালোবাসা হয় না।”
দল থেকে সুযোগ দেয়া হলে অবশ্যই জয়ী হতে পারতেন বলেও দাবি করেছেন আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের ব্যালটে থাকা জাহাঙ্গীর, যিনি সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েও চার হাজারের মতো ভোট পেয়েছেন।
“কিন্তু আমি অন্য একজনের পক্ষে কাজ করলে তাদের সবার অনুভূতি সমভাবে কাজ নাও করতে পারে। তারাতো আমার কর্মচারী নয় যে, আমি বললেই আমার কথা অনুসারে কাজ করবে।”
আওয়ামী লীগের বিভক্তি যে মান্নানের পক্ষে গেছে, তা উঠে এসেছে তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের কথায়।
“বিএনপি বিগত সরকারের সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক ঐক্যবদ্ধ। এ কারনেই মান্নান বিজয়ী হয়েছে। সরকারের দুর্নীতি, ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতির প্রভাবও নির্বাচনে পড়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বও রয়েছে।”
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় দলের ‘ভুলগুলো’ উঠে এলেও আজমতের পরাজয়ের কারণ শুধু স্থানীয় ইস্যু নয় বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটারদের অনেকেই। ১৮ দলীয় জোটের ‘হেফাজত’ তাস যে কাজে লেগেছে, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে তাদের কথায়।
কাশিমপুরের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম (৫০) বলেন, “এখানে মান্নান সাহেবের বিজয়ের একমাত্র কারণ হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে সরকারের ভূমিকা। সরকার নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করেছে।”
শহীদুল মানছেন, মান্নানের অনেক দুর্নাম থাকলেও আজমত সেই তুলনায় ‘ক্লিন’। তারপরও তিনি হেরেছেন, কারণ তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
রানী বিলাসমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলছেন, নানা কারণে তার এলাকায় ‘সরকারের ভাবমূর্তি’ খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই।
“ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মকাণ্ডে মানুষ অসন্তুষ্ট। রানা প্লাজা, পদ্মা সেতুর ঘটনাও প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া আজমত উল্লা টঙ্গীতে উন্নয়ন করতে পারেননি।”
গাজীপুর শহরের শিমুলতলী সড়কের ব্যবসায়ী মামুন মিয়া বলেন, “আমার মনে হয়, আজমত উল্লার হারের সবচেয়ে বড় কারণ আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে ভাগাভাগি। আমাদের এখানে অনেক দিন ধরে এমপি হন টঙ্গী এলাকা থেকে। আবার আজমত উল্লা খানও টঙ্গীর লোক। মান্নান সাহেব গাজীপুর সদরের লোক হওয়ায় এ এলাকা থেকে বেশি ভোট টানতে পেরছেন। তাছাড়া হেফাজত ইস্যুটাও কাজ করেছে।”
এ নির্বাচনেই প্রথম ভোট দিয়েছেন গাজীপুর মডেল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিবিএর শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তার কণ্ঠে ঝরল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ক্ষোভ।
“দেখেন এটা আমার জীবনের প্রথম ভোট। প্রথম ভোট আমি হামলাকারীদের দিতে পারি না। আমার এক কাজিন ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছে। আজমত আসলে এরা শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা মানুষের মাঝে ছিল।”
“আজমত-মান্নান ভোট হলে আজমতই জিততো। কিন্তু ভোটতো হয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির। শেয়ার বাজারের টাকা হারানো মানুষদের ব্যথা পরিবারের একজন সদস্য শহীদ হওয়ার মতো। ৩২ লাখ মানুষের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন বলেন, এই লোকরা কী আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে?”
নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী আজমত রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে ফল এসেছে, তা তিনি মেনে নিয়েছেন। তবে ক্ষোভের আঁচও ছিল তার কথায়।
“এখানে অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে কালো টাকা ছিটানো হয়েছে। নির্বাচনে ধর্মীয় ইস্যুকেও ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরও জনগণ আমাকে ভোট দেওয়ায় অভিনন্দন।”
দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে আন্তরিক ছিলেন কী না জানতে চাইলে আজমত বলেন, “তৃণমূলের কর্মীরা আন্তরিক ছিল। আপনার কথামতো যদি কেউ আন্তরিক না হয়ে থাকেন, তাদের বিবেক দংশন করবে।
“আমার পরাজয় যদি দলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাহলে সেটাই হবে বড় সহায়ক, বড় সান্ত্বনা।”