প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সমঝোতার সংলাপের গুঞ্জনের মধ্যে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজনীতিতে যোগদানের আহবান জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধি।
Published : 13 May 2013, 06:26 PM
বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরউল্লাহ চৌধুরী সোমবার এক অনুষ্ঠানে ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "আপনি যে প্রবন্ধ লিখেছেন, যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে ছাড়া সেগুলোর অন্য কোনোভাবে সমাধান সম্ভব নয়। অতএব মিষ্টি কথা ছাড়ুন, সাহসের সঙ্গে রাজনীতিতে আসুন।"
অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সাংবাদিকরা জাফরউল্লাহ’র অনুরোধের বিষয়ে ইউনূসের মতামত জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমি অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য দিয়েছি তার বাইরে কোনো কথা বলতে চাই না।”
সেখানে উপস্থিত ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘নো চান্স।’
সাভারে ভবন ধসের ঘটনা নিয়ে গুলশানের একটি হোটেলে এই অলোচনার আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)।
পিপিআরসি’র প্রতিষ্ঠাতা সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউনূসের জেলা চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া জিল্লুর। নোবেলজয়ীকে রাজনীতিতে ডাকা জাফরউল্লাহর বাড়িও চট্টগ্রামে।
সাবেক কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। ইউনূস নিজেও ১৯৯৬ সালের বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন।
আগামী নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে বিরোধ চলছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিএনপির দাবির বিপরীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় রাজনৈতিক সরকারের প্রস্তাবের পর চলছে দুই পক্ষের সমঝোতার গুঞ্জন।
দুই পক্ষের নানা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক কথা চালাচালি হচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে।
সর্বদলীয় সরকার নিয়ে আলোচনার খবরের মধ্যে নির্দলীয় বলে পরিচিত সাবেক উপদেষ্টাদের একই অনুষ্ঠানে উপস্থিতি কৌতূহল সৃষ্টি করে সংবাদকর্মীদের মধ্যে।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ইউনূস ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেয়।
ওই সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের গ্রেপ্তার হয় অনেক রাজনীতিক।
সেসময় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করার পর নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে খবর বের হয় ।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো ফাঁস হয়ে যাওয়া তারবার্তা থেকে জানা যায়, ইউনূস এই দুজনকে নির্বাসনে পাঠানোর বিষয়ে হাস্যরস করেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৭ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরাবৃত্তি রোধের যুক্তি তুলে ধরে সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থা বাতিল করে।
সরকারের বক্তব্য, এতে করে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার সুযোগ বন্ধ হবে।
বর্তমান সরকারের আমলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসৃত হন। বিষয়টি নিয়ে আদালতে গেলেও আইনী লড়াইয়ে হেরে যান তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই ঘটনার পর ইউনূসকে ‘সম্মান’ ফিরিয়ে দিতে সরকারকে চাপ দেয়।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূসও একে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে বর্ণনা করেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে।
‘সাভার ট্রাজেডি, শ্রমিক কল্যাণ এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট: কী করতে হবে’ শীর্ষক ওই সংলাপে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক এম এ তসলিম।
সম্প্রতি সাভারে ভবন ধসের পর ‘সাভার ট্র্যাজেডি, পোশাক শিল্প ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন ড. ইউনূস।
এতে তিনি বলেন, "সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক। রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিল আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে; সেটা আমলে না-নিলে জাতিও এ রকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে।"
ভবিষ্যতে সাভার ট্র্যাজেডির মতো দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু প্রস্তাবও ওই লেখায় দেন ইউনূস।
তার ওই লেখাটির ইংরেজি সংস্করণ রোববার বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশ হয় 'আফটার দ্য সাভার ট্র্যাজেডি, টাইম ফর অ্যান ইন্টারন্যাশনাল মিনিমাম ওয়েজ' শিরোনামে।
সোমবারের সংলাপে মুহাম্মদ ইউনূস তার ওই লেখাটির সূত্র ধরেই বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, ‘আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি বলা যায় তৈরি পোশাক শিল্পখাতকে। কিন্তু একে শুধু ব্যবসায়িক অবয়ব হিসেবে ভাবলে আমরা ভুল করব। জাতীয় অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু এই খাত।
“তবে শুধু অর্থনৈতিক নয়, খাতটিতে ভাবতে হবে সামাজিক দিক থেকেও। কারণ, ৪০ লাখ নারী এই খাতে কাজ করেন।”
ইউনূস বলেন, “গোটা বিষয়টিকে দেখতে হবে ডাক্তারের মত। অসুবিধা হচ্ছে, চিকিৎসা দরকার। কোনো দোষারোপ নয়। আর আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তিই যদি হয় পোশাক শিল্প খাত, তাহলে শ্রমিকদেরও আধুনিক মানুষ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সঠিক মজুরি দিতে হবে।
ইউনূস বলেন, “পোপের মতে ৪০ লাখ ক্রীতদাস রয়েছেন। আমরা যেন সত্যিই তাদের ক্রীতদাসে পরিণত না করি। তাদের মজুরী এমন হতে হবে যেন তারা সুখে মানুষ হিসাবে বসবাস করতে পারে। বিশ্ব দরবারে যেন আমরাও যেন বলতে পারি যে, ‘ক্রীতদাসের মতো বেঁচে থাকতে চাই না। বাঁচতে চাই মানুষ হিসেবে। আর, ক্রীতদাসের শ্রম বিক্রি করে আমরা অর্থনীতি গড়তে চাই না।’
ড.ইউনূস বলেন, “এমন এক সময় আমরা আলোচনা করছি, যখন সাভারের ধ্বংসস্তুপ থেকে এখনও বের করে আনা হচ্ছে শ্রমিকের লাশ। আর এটি এমন এক ঘটনা, যা আমাদের মন থেকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। এত বড় ঘটনার পরও যদি আমাদের বোধোদয় বা পরিবর্তন না হয়, তাহলে ধিক্ আমাদেরকে।”
সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টাদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, জামিলুর রেজা চৌধুরী ও গোলাম কাদের।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাও বক্তব্য দেন ওই সংলাপে।