মাত্র ২২ বছর বয়সে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ভার কাঁধে তুলে নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সিলেটবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে থেকে হয়ে উঠেছিলেন ‘গণমানুষের নেতা’।
Published : 15 Jun 2020, 01:44 PM
রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, মানুষের যে ভালোবাসা কামরানের জন্য ছিল, তা কখনও ‘ফুরিয়ে যাবে না’।
সিলেটের রাজনীতিতে সবচেয়ে পরিচিত মুখ কামরান কীভাবে তার এই রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করলেন?
শুরুটা হয়েছিল সিলেট পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে। এরপর পৌরসভার চেয়ারম্যান। সিলেট যখন শহর থেকে মহানগর হল, তাকেই মানুষ বেছে নিয়েছিল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তৃণমূল থেকে উঠে আসা কামরান এই পুরো যাত্রাপথে মানুষের সঙ্গেই ছিলেন। ভোটের রাজনীতিতে নগর ভবন থেকে ছিটকে পড়লেও মানুষের কাছ থেকে কখনো দূরে সরেননি তিনি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে মারা যান সিলেটের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তার বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি ছিলেন তৃণমূলের নেতা। তৃণমুলের নেতাকর্মীদের নিয়েই ছিল তার রাজনীতি। জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি সব শ্রেণির মানুষের সাথে মিশতেন, সেভাবেই তিনি ধীরে ধীরে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন।”
নাদেল বলেন, কামরানের মৃত্যু সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য ‘অপূরণীয় ক্ষতি’।
কামরান এলাকায় মানুষের সুখ-দূঃখে পাশে দাঁড়াতে শুরু করেছিলেন কৈশোরেই। তাদের সমর্থনেই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় পৌরসভার ভোটে দাঁড়ান তিনি।
১৯৭৩ সালের সেই নির্বাচনে ৬৪২ ভোট পেয়ে সিলেট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন কামরান। সে সময় তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি।
সিলেটের পুরনো আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে জানা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কামরান এমসি কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। একজন পৌর কমিশনার হয়ে যখন তিনি কলেজে ক্লাস করতে যেতেন, ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে আলাদা চোখে দেখতেন। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে রসিকতা করে ডাকতেন ‘কমিশনার সাব’ বলে।
তবে এমসি কলেজে সে সময় উপস্থিতির ক্ষেত্রে খু্ব কড়াকড়ি ছিল। আর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব সামলে সব সময় ক্লাস করা কামরানের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে তাই কামরানকে কলেজ পরিবর্তন করতে হয়। সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান তিনি।
এলাকাবাসীর সমর্থনে ১৫ বছর পৌর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামরান। মাঝে কিছুদিন বিদেশে থাকায় একবার তার নির্বাচন করা হয়নি।
কামরানের জীবন পরিক্রমায় সাফল্য ছিল পদে পদে। বিদেশ থেকে ফিরে এসে ১৯৯৫ সালে তিনি সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০০৭-০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই দফা গ্রেপ্তার হয়ে ১৮ মাস কারাবন্দি ছিলেন কামরান। সে সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে থেকে নির্বাচন করেও বিপুল ভোটে জয়ী হন।
২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে গিয়ে মেয়র পদ হারান কামরান। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি লড়েছিলেন, কিন্তু জয়ী হতে পারেননি।
কামরান আওয়ামী লীগের রাজনীতি যুক্ত হয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের হাত ধরে।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, ছেলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রথম দিকে সরকারি চাকরিজীবী বাবার আপত্তি ছিল। তবে এলাকায় ছেলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে তিনি আর বাধা দেননি।
১৯৮৯ সাল থেকে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন কামরান। সেই দায়িত্ব তিনি সামলেছেন প্রায় দেড় যুগ।
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ পাওয়া কামরান বর্তমান কমিটিতেও একই পদে ছিলেন।
২০১৯ সালে নতুন কমিটি গঠিত হলে মহানগরের সভাপতি পদে নতুন মুখ আসে। তবে কামরান রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাননি। দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে কর্মীদের সাথে তাকে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাঙ্গঠনিক সম্পাদক মেজবাহউদ্দিন সিরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কামরান যখন সিলেট মহানগরের সাভপতি তখন দুই মেয়াদে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার সঙ্গে ছিলেন।
“সাধারণ মানুষের দুঃসময়ে তিনি সবার আগে হাজির হতেন। সে কারণে মানুষের হৃদয়ে তিনি দ্রুত স্থান করে নিয়েছিলেন। পরপর দুইবার সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। মানুষের যে ভালোবাসা তার জন্য ছিল, সেটা কখনও ফুরিয়ে যাবে না। তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা কামরান সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সদস্য ছিলেন তিনি।