পরের তিন বিসিএসের সব ধরনের কার্যক্রম বাতিলের দাবি।
Published : 17 Oct 2024, 04:29 PM
দুই দিন আগে ২০৬৪ জনকে নিয়োগে ৪৩তম বিসিএসের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় তা বাতিলের দাবি তুলেছে বিএনপি। পাশাপাশি ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষার সব ধরনের কার্যক্রম বাতিলের দাবিও জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘‘পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের দোসর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এবং ছাত্র—জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সম্প্রতি পদত্যাগকারী দলকানা পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় বিসিএস ৪৩তম ব্যাচের সুপারিশকৃত ২০৬৪ জন প্রার্থীকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
“অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ও নিয়োগ প্রক্রিয়া দেশের মানুষকে চরমভাবে হতভম্ব ও হতাশ করেছে এবং জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।”
বিএনপির তরফে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঢালাওভাবে সুপারিশকৃত শাসকদলীয় প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে নিয়োগ দান করা হলে তা হবে চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
“দেশের হাজার হাজার যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীদের বঞ্চিত করে দলীয় ভিত্তিতে বিবেচিত ও সুপারিশকৃত ৪৩তম বিসিএস বাতিল করার জন্য আমরা দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।”
একইসঙ্গে ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি জানিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি হাসিনা সরকারের সময় ইতোমধ্যে আবেদনকৃত ৪৪তম বিসিএসের যে ৯ হাজার জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়েছিল, তার মধ্যে ৩ হাজার জনের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত উত্তরপত্রের মূল্যায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
“৪৬ বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে তিন মাস পূর্বে। আমরা দাবি করছি- রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে প্রবেশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী গোষ্ঠীর এবং সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনীকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে এই তিনটি বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়াসমূহ পুরোপুরি বাতিল করা হোক। জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবে দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে ফ্যাসিবাদের দোসরদের যেকোনো মূল্যে রুখে দিতে হবে।”
এরইমধ্যে ছেচল্লিশতম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের একটি দল দ্রুত লিখিত পরীক্ষার রুটিন প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে এ বিষয়ে আপস করার বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে যেখানে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার জোর দাবি জানানো হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ৪৩তম বিসিএসের ঢালাও নিয়োগদানের মাধ্যমে সেই সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের সরকারি প্রশাসনের উচ্চতর পদসমূহে পুনর্বাসন করার এই অন্তর্ঘাতমূলক সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার পরিপন্থি এবং কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
কোভিড মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ জন প্রার্থী অংশ নেন। পরে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
তাদের মধ্যে ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন ২ হাজার ১৬৩ জন। মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২ হাজার ৬৪ জনকে ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
৪৩তম বিসিএস ফলের সুরাহা বিএনপি কীভাবে চায়, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘ এখানে আমরা বলেছি, অতীতে ২৭তম বিসিএস একটা নজির রয়েছে। সেটা ২০০৭ সালে যে ২৭তম বিসিএসের এর চূড়ান্ত ফলাফল বাতিল করা হয়েছিল, পরে পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল।
‘‘আমরা ওই একই প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য- যাতে জাস্টিস এনসিউর হয়, সেটা প্রেসক্রাইব করেছি। একই সঙ্গে ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছি। আমরা আবেদনকারীদের আবেদন করতে বলছি না।”
প্রশাসনে দলীয়করণ ‘আওয়ামী লীগের হাত ধরে’
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আপনারা অবগত রয়েছেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় বিনা পরীক্ষায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতার্দশে বিশ্বাসী নিজ দলীয় ক্যাডার বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যকে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ প্রদান করে। এর মাধ্যমেই একটি সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনে প্রথমবারের মত নগ্ন দলীয়করণের সূচনা হয়।
“এরাই ১৯৯৬ সালে প্রশাসনের ইন-সার্ভিস কর্মকর্তাদে চাকরির শৃঙ্খলা এবং সমস্ত নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রথমবারের মত তথকথিত ‘জনতার মঞ্চের’ আড়ালে আওয়ামী লীগের বিধ্বংসী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে দেশকে ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসেই প্রশাসনিক সমস্ত নিয়মনীতি শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধকে ভেঙে দিয়ে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিজেদের আজ্ঞাবহ দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল।”
তিনি বলেন, ‘‘পুনরায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সনের ৫ অগাস্ট পতনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার দেশের গেজেটেড-নন গেজেটেড সকল পদে প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয় কর্মী বাহিনী নিয়োগের মাধ্যমে একচ্ছত্র আওয়ামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।
“নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, প্রমোশনসহ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করেছিল দেশের হাজার হাজার যোগ্য ও মেধাবী তরুণ-তরুণীদের। বেড়ে গিয়েছিল সীমাহীন বেকারত্ব। সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে এই ৪৩তম বিসিএস।”
‘পিএসসি দলীয়করণ’
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘এক সময়, যে পাবলিক সার্ভিস কমিশন ছিল প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের সেরা প্রতিষ্ঠান এবং যা ছিল জাতীয় গৌরবের বিষয়- ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ শাসনামলে সেই পিএসসিকে এক আজ্ঞাবহ দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। একদিন যে প্রতিষ্ঠান দেশের জ্ঞানী-গুণী এবং আদর্শস্থানীয় বিদগ্ধজনেরা নেতৃত্ব দিতেন, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সেই প্রতিষ্ঠান দলীয় ক্যাডারদের আস্তানায় পরিণত হয়েছিল।
“দলীয়করণ এতোই নগ্নরূপ ধারণ করেছিলো যে পুরস্কার স্বরূপ পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যানকে ডামি নির্বাচনের এমপি নির্বাচিত করা হয়েছিল। তিনি এখন পলাতক রয়েছেন। জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে?”
তিনি বলেন, ‘‘এই সব দলবাজ কর্মকর্তাদের দ্বারা ঢালাওভাবে সুপারিশকৃত শাসকদলীয় প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে নিয়োগ দান করা হলে তা চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি।”
৫ অগাস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে ধারাবাহিক রদ-বদলের মধ্যে ৮ অক্টোবর পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনসহ কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করেন। এরপর মঙ্গলবার পিএসসি চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম ও চার সদস্য শপথ নেন।
পিএসসি সংস্কারের দাবি জানিয়ে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন বলেন, “এই দাবির সাথে সঙ্গতি রেখে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে জানা যায়। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এর ফলে বঞ্চিত মেধাবীদের অন্তত একটি অংশ হলেও বিভিন্ন চাকরিতে নতুন করে আবেদনের সুযোগ পাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
‘‘পিএসসি সংস্কার দাবির প্রেক্ষিতে পিএসসির নতুন একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সদস্যকে ইতোমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, পিএসসির সংস্কার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নতুন করে সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত যেন- চাকরি প্রার্থীরা পরিবর্তিত পিএসসি’র সুফল পায় এবং সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জাতির আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।”
তিনি বলেন, ‘‘ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরকারি, আধাসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিসহ প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন নন-ক্যাডার পদে নতুন চাকরি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আমরা মনে করি, এসব পদে যারা ইতোমধ্যে আবেদন করেছেন- তাদের পাশাপাশি আবেদনের সময়সীমা বাড়িয়ে নতুন করে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হোক।”
‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই’
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘ জাতির সামনে একটি বিষয় আমরা স্পষ্ট করতে চাই। আমরা ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই।
“আর সেজন্যই আওয়ামী দলীয় পিএসসি কর্তৃক প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগকৃত, সুপারিশকৃত কিংবা সুপারিশের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরছি- যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সকল প্রকার প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।